তাকলীদ
তাকলীদের সংজ্ঞা
“অন্যের কথা অনুযায়ী আমল করা তার কাছে কোন আবশ্যকীয় দলীল প্রার্থনা না করেই।”
তাকলীদের প্রমাণসমূহ
আকীদার ক্ষেত্রে তাকলীদ জায়েজ নেই। যেমন অনেক আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। তবে শরয়ী আহকামের ক্ষেত্রে তাকলীলের বৈধতা নিম্নোক্ত নুসূস ও আয়াতসমূহ দ্বারা সাব্যস্ত হয়।
“যদি তোমরা নিজেরা না জানো তবে যারা জানে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও।” (সূরা ২১ আয়াত: ৭)
এখানে এই প্রশ্ন হতে পারে যে, উক্ত আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আহলে কিতাব। তাহলে এই আয়াত দ্বারা মুসলমানদেরকে কিভাবে উদ্দেশ্য করা যেতে পারে?
এর উত্তর হলো: এটা সঠিক যে এই আয়াত আহলে কিতাবদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে মূলনীতি হলো:
“শব্দের ব্যাপকতা গ্রহণ যোগ্য হবে, নির্দিষ্ট সবব (কারন) বা শানে নুযূল বিবেচ্য নয়।”
উক্ত আয়াতে “জ্ঞানী” শব্দের ব্যাপকতার মধ্যে মুসলমানরাও অন্তর্ভুক্ত। কেননা মহান আল্লাহর ঘোষণা:
“আর নিশ্চয়ই আমি আপনার কাছে এক উপদেশ গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি। যাতে করে আপনি তা খুলে খুলে লোকদেরকে বুঝিয়ে দেন যে (তাদের উপর তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে) কি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ফলে তারা বিষয়গুলো বুঝে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারবে।” (সুরা ১৬-৪৪)
এখানে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনকে যিকর শব্দ দ্বারা উল্লেখ করেছেন। এর থেকে মুসলমানদের আহলুয যিকর এর অন্তর্ভুক্ত হওয়াটা সাব্যস্ত হয়। এখানে এটা বলা যাবে না যে, আয়াত যেহেতু ঈমানের বিষয়ে অবতীর্ণ হয়েছে তাই একে আহকাম সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিভাবে আনা যায়?
এটা এজন্য বলা যাবে না যে, আয়াতের আলোচ্য বিষয় ‘মা'রেফাত’ বা আবগতি। অর্থাৎ আয়াতের মধ্যে অনবগতদেরকে অবগত লোকদের শরণাপন্ন হতে বলা হয়েছে। কেননা, فسئلوا শব্দটি ব্যাপক। এর মধ্যে শরয়ী আহকামও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
এছাড়া হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসেও উল্লেখ আছে যে, এক ব্যক্তি গোসল ফরজ অবস্থায় ছিল এবং তার মাথায় একটি আঘাতের কারণে যখম ছিল। গোসল করার ব্যাপারে তাই তিনি কতিপয় সাহাবায়ে কিরাম রা. এর কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, যেহেতু তিনি অসুস্থ তাই তার জন্য গোসল ছাড়া কোন রুখসত রয়েছে কি না? কিন্তু তারা ‘না’ বলার কারণে সে গোসল করে এবং একারণে তার মৃত্যু হয়। এ ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সা. রাগান্বিত হয়ে বলেন:
“তার জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল যে সে মাথায় একটি কাপড় বেঁধে তায়াম্মুম করে নিবে এবং মাথা মাসাহ করবে আর বাকী শরীরকে ধৌত করে নিবে। তারা যখন আসল হুকুম জানতো না তখন তারা কারো কাছে বিষয়টি কেন জিজ্ঞেস করলো না? নিশ্চয়ই অজ্ঞতার সমাধান হলো জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়া।” (আবূ দাউদ)
এই সকল দলীলের আলোকে মুকাল্লিদের জন্য মুজতাহিদের তাকলীদ করার বৈধতা প্রমাণিত হয়। যেহেতু তারা নিজেরা নস থেকে হুকুম আহকাম বের করতে সক্ষম নয়, তাই তাদের জন্য ওয়াজিব হলো তারা কোন মুজতাহিদের তাকলীদ করবে।
স্মরণ রাখা উচিত যে, তাকলীদ দ্বারা কোন ব্যক্তির তাকলীদ উদ্দেশ্য নয়। বরং এই হুকুম হলো আল্লাহর মা'রেফাত অর্জনের জন্য যেন সে এই গ্রহণকৃত শরয়ী হুকুমের উপর আমল করতে পারে। যদি কারো ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বত্ত্বাগত তাকলীদ করা হয় তাহলে এটা হারাম। কেননা মুসলমান কেবলমাত্র আল্লাহর হুকুমেরই আনুগত্য করে, কোন মানুষের নয়।
তাকলীদ আসল (মূল হুকুম) নয়
মুকাল্লাফের জন্য মূল কাজ হলো সে নিজেই আল্লাহর হুকুমকে নুসূস থেকে বের করে অবগত হবে। কেননা, মহান আল্লাহ তা‘আলা তার খেতাবের মধ্যে কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় তথা মুজতাহিদীন ও উলামায়ে কিরামকে লক্ষ্য করে নির্দেশনা দেননি। বরং তিনি সকল মানবজাতিকে লক্ষ্য করেই সম্বোধন করেছেন। একারণেই মুকাল্লাফের জন্য তাকলীদ আসল নয়। কেননা আল্লাহর নিম্নোক্ত ফরমান:
“আর যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই তার অনুসরণ করো না। কেননা, শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি এবং অন্তর সম্পূর্ণই জিজ্ঞাসিত হবে।” (সুরা ১৭-৩৬)
তাকলীদ যেহেতু দলীলহীনভাবে করা হয়ে থাকে তাই এর দ্বারা ইলম ও একীন অর্জন হয় না। এটা কেবল অকাট্য দলীল দ্বারাই হওয়া সম্ভব। অবশ্য এই দলীল মুকাল্লিদের জন্য আবশ্যকীয় নয়, ইজতিহাদের মাধ্যমে মুজতাহিদের জন্য বিষয়টি যেমন আবশ্যক হয়।
সুতরাং যে আল্লাহর সম্বোধন শুনলো তার উপর আবশ্যক হলো এর উপর সে ঈমান আনবে। আর যে কিনা মহান আল্লাহর কোন নির্দেশ শুনে তার উপর ঈমান আনলো তার জন্য শরয়ী আহকামের উপর আমল করার জন্য নুসূস থেকে পূর্ণ বিষয়টি অনুধাবন করা অপরিহার্য। তবে যেহেতু মহান আল্লাহর এই সম্বোধনকে নুসূস থেকে পূর্ণরূপে অনুধাবন করা প্রত্যেকের জন্য সম্ভব নয় এজন্য তাকলীদ কেবল অক্ষমতা ও অপারগতার কারণে স্বীকৃত হয়েছে।
এক মাসআলায় একই মুজতাহিদের তাকলীদ
স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, মুকাল্লিদের জন্য এটি আবশ্যক যে, তিনি এক মাসআলার মধ্যে একই মুজতাহিদের তাকলীদ করবেন। তবে তার জন্য ভিন্ন মাসআলায় অন্য মুজতাহিদের তাকলীদ করা জায়েজ আছে। এর উপর ইজমায়ে সাহাবার দলীলও বিদ্যমান। সুতরাং এটি আবশ্যক নয় যে সকল মাসআলায় একই মুজতাহিদের তাকলীদ করা হবে। তবে এটা আবশ্যক যে একই মাসআলায় একই মুজতাহিদের তাকলীদ করতে হবে।
অন্যথায় এই ধারণা প্রবল হবে যে, আসলে সে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করছে। অর্থাৎ যেই হুকুম তার কাছে সহজ বলে মনে হয় সে তার অনুসরণ করে। আর এমনটি হারাম। কেননা এই অবস্থায় সে আল্লাহর হুকুমের আনুগত্য নয় বরং নিজের ইচ্ছার প্রবৃত্তির দাসত্ব করছে। আর আল্লাহর ঘোষণা:
“আর তোমরা স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না।” (৪-১৩৫)
মুকাল্লিদের প্রকারভেদ
মুকাল্লিদ দুই প্রকার।
১. মুকাল্লিদে আমী
২. মুকাল্লিদে মুত্তাবি’
১. মুকাল্লিদে আমী”
মুকাল্লিদে আমী হলো ঐ প্রকার, যা গ্রহণযোগ্য নয় এমন তাশরীয়ি উলূমের মাধ্যমে কয়েক মুজতাহিদের তাকলীদ করা হয় দলীল প্রমাণ ব্যতীত। অর্থাৎ কেবলমাত্র ফতোয়ার উপর নির্ভর করা এবং আমল করা হয়। এটা কেবলমাত্র কোন মুজতাহিদের সত্যবাদীতা এবং ইলমের উপর ভরসা করে তার তাকলীদ করা হয়।
২. মুকাল্লিদে মুত্তাবি’
মুকাল্লিদে মুত্তাবি’ হলো ঐ প্রকার, যা কতিপয় গ্রহণযোগ্য তাশরীয়ি উলূমের মাধ্যমে অর্জিত হয়। কিন্তু ইজতিহাদের জন্য যথেষ্ট নয় এবং এতে মুজতাহিদের তাকলীদ দলীলের ভিত্তিতে করা হয়। অর্থাৎ যা কিছু দলীলের মাধ্যমে তার সামনে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়, এই দলীলের উপর নিশ্চয়তা দেখে এর উপর ভিত্তি করে মুজতাহিদের তাকলীদ করা হয়।
উভয় প্রকারের মধ্যে এ বিষয়টা সুস্পষ্ট যে, তাকলীদে আম্মী’র উপর তাকলীদে মুত্তাবি’ এর মর্যাদা বেশী। কেননা এ প্রকারের ইত্তিবা ইজতেহাদের দিকে নিয়ে যায়।
ইত্তিবা’র মধ্যে দলীল-প্রমাণের দিক থেকে গভীর অবগতি এবং ঈমান সূদৃঢ় হওয়ার কারণ হয় এবং উম্মতের দ্বিতীয় পূনর্জাগরণের উসীলাও। কেননা, সতর্কতা ও অবগতির ভিত্তির উপর জীবনের সকল মাসআলার মূল ভিত্তির দিকে ফিরানো এবং তার উপর আমল করার নামই হচ্ছে দ্বিতীয় পুনর্জাগরণ।