তাকলীদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা
তাকলীদঃ
শব্দগত অর্থে তাকলীদ হচ্ছে যাচাই-বাছাই না করে অন্যকে অনুসরণ করা । বলা যায়, সে তাকে এভাবে এভাবে অনুকরণ করেছে অর্থাৎ সে তাকে যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনুকরণ করেছে । ফিকাহ্ অনুযায়ী তাকলীদ হচ্ছে, অন্যের বক্তব্য কোন দলিল বা যুক্তি প্রমাণ দিয়ে বিচার না করে অনুসরণ করা যেমন, কোন উম্মি ব্যক্তির কোন মুজতাহিদের মতামতকে গ্রহণ করা বা কোন মুজতাহিদের তার সমমর্যাদার কোন মুজতাহিদের ইজতিহাদ মেনে চলা।
শরীয়াহ আইনে তাকলীদের প্রমাণঃ
শরীয়াহ আইনানুযায়ী তাকলীদ সকল মুসলমানের জন্য অনুমোদিত । আল্লাহ (সুব:) বলেনঃ
“যদি তোমরা না জান তাহলে জ্ঞানীদের (আহল আল-জিকির) নিকট জিজ্ঞাসা কর ।”(সূরা আম্বিয়া: ০৭)
আল্লাহ (সুব:) যার জ্ঞান নেই তাকে যার জ্ঞান আছে তার কাছ থেকে জানার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। উপরোক্ত আয়াতটি মুশরিকদের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়। মুশরিকদের অভিযোগ ছিল মানুষ স্বয়ং কখনও নবী-রাসূল হতে পারেনা। তাদের অভিযোগের জবাবে আল্লাহ (সুব:) মুশকিদেরকে আহলে কিতাবদের কাছ থেকে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ সম্পর্কে জানতে বলেন যে তারা মানুষ ছিল কিনা। কেননা মুশরিকরা এ ব্যাপারে ছিল অজ্ঞ এবং আহলে কিতাবরা এ ব্যাপারে ছিল জ্ঞাত। এই আয়াতের বক্তব্য সাধারণ এবং কোন বিশেষ কারণ বা বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত নয় বরঞ্চ সাদামাটাভাবে যারা জানেনা তাদের প্রতি, যারা জানে তাদের কাছ থেকে জানার জন্য তাগিদ। ফাসআ’লু (জিজ্ঞাসা কর) শব্দটি সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে অর্থ্যাৎ আল্লাহ (সুব:) পূর্ববর্তীদের নিকট মানুষ ছাড়া কাউকে নবী হিসাবে পাঠাননি এ বিষয়টি জানার জন্য জিজ্ঞাসা কর । শব্দটি জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত, বিশ্বাসের সাথে নয় ।
সন্দেহাতীতভাবে বর্ণিত যে, আল-শাবী বলেন, রাসূল (সা:) এর ছয়জন সাহাবী ছিলেন যারা ফিকাহ সম্পর্কিত বিষয়ে রায় দিতেন । এই ছয়জন হলেন ইবনে মাসুদ (রা:), উমর বিন খাত্তাব (রা:), আলী ইবনে আবি তালিব (রা:), যায়িদ বিন সাবিত (রা:), উবাই ইবনে কা’ব (রা:) এবং আবু মুসা (রা:)। এদের মধ্যে তিন জন অন্য তিন জনের মতামতকে প্রাধান্য দিতেন। ইবনে মাসুদ উমার (রা:) এর রায়কে প্রধান্য দিতেন, আবু মুসা (রা:) আলী (রা:) এর রায়কে প্রধান্য দিতেন, যায়িদ (রা:) উবাই ইবনে কা’ব (রা:) এর রায়কে প্রাধান্য দিতেন। এ থেকে আমরা দেখতে পাই সাধারণ মুসলমানরা যেমনি সাহাবীদের অনুকরণ করত তেমনি সাহাবীদের কেউ কেউ অন্য সাহাবীদের অনুকরণ করতেন ।
তাকলীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত মাপকাঠি:
মুসলমানদের সামনে যখন কোন বিষয় উপস্থাপিত হয় তা না জেনে পালন করার অনুমতি নেই যেহেতু আল্লাহ (সুব:) এর উপাসনা অজ্ঞভাবে নয়, জেনে এবং বুঝে করতে হবে। আল্লাহ (সুব:) এর ঐসব নিয়ম-কানুন জানা মুসলমানদের জন্য ফরয যা কোন কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয়। কারণ মুসলমানদের এগুলো সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে উক্ত বিষয় পালন করা সম্ভব নয়। মুসলমানদের এ জ্ঞান দরকার আল্লাহর হুকুম প্রনয়ণ ও সে অনুযায়ী কাজ করার জন্য ।
আল্লাহ (সুব:) বলেন, “তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীদের নিকটজিজ্ঞাসা কর ।” (সূরা আম্বিয়াঃ ০৭)
যখন কোন বিষয়ে দুই মুজতাহিদের ভিন্ন ভিন্ন মতামতের কারণে মতানৈক্য দেখা দেয়, তখন মুকাল্লিদ ব্যক্তির কোন একটি পছন্দ করার সুযোগ নেই । কেউ কেউ মনে করেন মুকাল্লিদ ব্যক্তির কাছে দুইটি মতামত একটি মতামতেরই শামিল । তারা মনে করেন, দুটির মধ্যে একটি তার নিজের ইচ্ছানুযায়ী অনুসরণ করার সুযোগ আছে, কিন্তু ব্যাপারটি এমন নয় কারণ মুসলমানদেরকে হুকুম শরীয়াহ মানার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যখন কোন মুকাল্লিদ দুই মুজতাহিদের মধ্যে সাংঘর্ষিক কোন মতামত পায় তখন নিজের সুবিধামত একটি গ্রহন করা নিষেধ । কারণ মুজতাহিদগণ দলিলের অনুসারী এবং দুজনেই দু সাংঘর্ষিক দলিল ব্যবহার করেছেন । মুসলমানদেরকে নিজের সুবিধামত একটি গ্রহন করা নিষেধ।
আল্লাহ (সুব:) বলেন, “তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হয়োনা ।” (সূরা নিসা: ১৩৫)
মুকাল্লিদ ব্যক্তির দুই দলিল তুলনা করা ছাড়া কোন উপায় নেই । মুকাল্লিদ ব্যক্তির নিকট দুই মুজতাহিদ মূলত দুটি দলিলের সমতূল্য । মুজতাহিদের জন্য যেমনি দু’টি সাংঘর্ষিক দলিল তুলনা করে দেখা বাধ্যতামূলক তেমনি মুকাল্লিদ ব্যক্তির জন্যও দুই সাংঘর্ষিক রায়কে তুলনা করে দেখতে হবে।
আল্লাহ (সুব:) বলেন, “(এবং) কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে উহা উপস্থিত কর আল্লাহ ও তার রাসূলের নিকট ।” (সূরা নিসা: ৫৯)
মুকাল্লিদ ব্যক্তির আল্লাহ ও রাসূলের কাছে ফিরে যাওয়া মানে এমন কিছু করা যা আল্লাহ (সুবহা:) ও রাসূল (সা:) কে খুশী করে। মুকাল্লিদ ব্যক্তির জন্য দুটি রায়কেই গ্রহন করা সম্ভব নয়, যেহেতু তা সাংঘর্ষিক । তুলনা না করে দুই মাযহাবের যে কোন একটি গ্রহণ করা মূলত ইচ্ছানুযায়ী পছন্দ করার শামিল, যা আল্লাহ (সুবহা:) ও রাসূল (সা:) এর কাছে ফিরে যাওয়ার বিপরীত।
যার উপর ভিত্তি করে মুকাল্লিদ একজন মুজতাহিদের উপর অন্যজনকে প্রধান্য দেয়, অথবা কোন এক হুকুম থেকে অন্য হুকুমকে প্রধান্য দেয় তা হচ্ছে জ্ঞান এবং বুঝার ক্ষমতা। এজন্য মুকাল্লিদ ব্যক্তি মুজতাহিদের জ্ঞান ও বিশ্বাসযোগ্যতা পরিমাপ করবে কারণ স্বাক্ষীর সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা একটি শর্ত। মুজতাহিদ যখন হুকুম শরীয়াহ সংজ্ঞায়িত করেন এটাই তার সাক্ষ্য, কেননা তার মাধ্যমে আমরা ঐ হুকুম সম্পর্কে অবহিত হই। সুতরাং কোন হুকুম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ঐ হুকুম যিনি শিক্ষা দেন তার সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ এবং যিনি ইজতিহাদ করে হুকুম বের করেন তার সততা অতীব প্রয়োজনীয় । জ্ঞানই হচ্ছে সঠিক যোগ্যতা যার ভিত্তিতে তুলনা করা যায় । যিনি মনে করেন ইমাম শাফী (র:) তুলনামূলক বেশী জ্ঞানী ছিলেন এবং তার মাযহাব অপেক্ষাকৃত বেশি ঠিক, সে তার নিজের ইচ্ছানুযায়ী অন্য মাযহাব গ্রহণ করতে পারেনা । মুকাল্লিদ ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন মাযহাব থেকে তার কাছে যা বেশি গ্রহনযোগ্য মনে হয় তা পছন্দ ও গ্রহণ করার অধিকার নেই ।
মাযহাব পরিবর্তন:
আল্লাহ (সুব:) আমাদের কোন মুজতাহিদ, ইমাম বা মাযহাব অনুসরণ করার নির্দেশ করেননি, বরং তিনি (সুব:) আমাদেরকে হুকুম শরীয়াহ পালন করতে আদেশ করেছেন । তিনি (সুব:) আমাদের রাসূল (সা:) যা বলেছেন তা মানতে এবং যা নিষেধ করেছেন তা ত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছেন ।
আল্লাহ (সুব:) বলেন, “এবং রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহন কর এবং যা করতে নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাক।” (সূরা হাশর: ০৭)
তাই শরীয়াহ আমাদের আল্লাহ (সুব:) এর নিয়ম অনুসরণের কথা বলে, কোন মানুষের কথা নয় । বাস্তবে তাকলিদ মুসলমানদের নির্দিষ্ট মুজতাহিদ যারা ইমাম হিসাবে গৃহীত তাদের ইজতিহাদ অনুসরণ করতে বলে এবং নিজেদের মাজহাব হিসেবে ঐ মুজতাহিদের ইজতিহাদকৃত নিয়ম-কানুন প্রনয়ণ করতে বলে। যার কারণে মুসলমানদের মধ্যে শাফী, হানাফী, মালিকি, হাম্বলী ইত্যাদি মাযহাব রয়েছে। যদিও মুসলমানরা এসকল মুজতাহিদের ইজতিহাদকৃত শরীয়াহ আইন অনুসরণ করে, এটা করা তাদের জন্য আইনসিদ্ধ কারণ এটা মূলত শরীয়াহ আইনেরই অনুসরণ । যারাই মাযহাব অনুসরণ করে তাদের বোঝা উচিত তারা শুধুমাত্র আল্লাহর আইনই অনুসরণ করে যা ঐ সকল ইমাম কর্তৃক ইজতিহাদকৃত ।
মাযহাব অনুসরণের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য। অন্যদিকে মাযহাব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অন্য নিয়ম। যদি কেউ কোন ইজতিহাদ গ্রহণ করেন কিন্তু তা পালন করা শুরু না করেন তাহলে তিনি তা পরিবর্তন করতে পারেন শুধুমাত্র আল্লাহর (সুব:) এর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। যদি তিনি উক্ত বিষয় পালন করা শুরু করেন তাহলে তা তার জন্য আল্লাহর (সুবহা:) হুকুম হয়ে যায়। তখন তার জন্য অন্য হুকুম পালন করা বৈধ নয় । তবে যদি দ্বিতীয় ইজতিহাদ গ্রহনযোগ্য দলিলের উপর ভিত্তি করে হয় এবং প্রথম ইজতিহাদ দলিলের উপর ভিত্তি করে না হয় তাহলে তিনি তা পরির্বতন করতে পারেন। অথবা যদি এমন হয় যে দ্বিতীয় ইজতিহাদের দলিলসমূহ অধিক গ্রহনযোগ্য এবং তা তাকে প্রভাবিত করে তাহলেও তিনি প্রথম ইজতিহাদ পরিহার করতে পারেন। এটা মুজতাহিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যখন তিনি নিজের ইজতিহাদের দলিলের চেয়ে অন্য ইজতিহাদের দলিল অধিক গ্রহনযোগ্য মনে করেন তখন নিজের ইজতিহাদ পরিহার করতে পারেন। অন্য কোনভাবে মুকাল্লিদ ব্যক্তির সে যে মাযহাব পালন করে আসছে তা পরিবর্তনের সুযোগ নেই ।
অন্য কোন হুকুমের ক্ষেত্রে যা এখনও সে পালন করেনি সেক্ষেত্রে অন্য মুজতাহিদের ইজতিহাদ পালন করতে পারেন যা ইজমা-ই-সাহাবা কর্তৃক গৃহীত । যখন কোন মুকাল্লিদ ব্যক্তি কোন মাযহাব নির্ধারণ করেন এবং বলেন (উদাহরণ স্বরূপ) আমি শাফী বা হানাফী মাযহাব অনুসরণ করি, সেক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে তিনি ঐ মাযহাব ব্যতীত অন্য কোন মুজতাহিদের অনুসরণ করতে পারবেননা যেসব বিষয় তিনি স্বীয় মাযহাবের অনুশীলন করে আসছেন। যেসব বিষয় তিনি অনুশীলন করেননি সেসব ক্ষেত্রে অন্য মুজতাহিদকে অনুসরণ করতে পারবেন ।
মুকাল্লিদ কোন মুজতাহিদ, ইমাম বা মাযহাব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ঐ হুকুমের সাথে সম্পর্কিত যাবতীয় ইস্যু পরিহার করতে হবে। সবগুলো ইস্যু পরিহার না করলে হুকুমটি পরিহার করা যায়না কারণ ঐসবগুলো ইস্যু মিলেই ঐ একটি মূল ইস্যু বা হুকুম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নামাযের সাথে সম্পর্কিত ওযু ও অন্যান্য বিষয়। যে শাফী মাযহাব অনুসরণ করে তার জন্য নামাযের ক্ষেত্রে হানাফীর ওযুর হুকুম পালন অর্থ্যাৎ মহিলাদের স্পর্শ করলে ওযু ভঙ্গ হয়না এই নীতি অনুসরণ করে নামায পড়া বৈধ নয়। অন্যভাবে বলা যায় সূরা ফাতিহা পড়া নামাযের রুকন নয়- এটি হানাফী মত যা অনুসরণ করে শাফী মাযহাব অনুযায়ী নামায পড়া বৈধ নয়। কোন হুকুম গ্রহণ বা পরিহারের ক্ষেত্রে অন্য মাযহাব অনুযায়ী গৃহীত হুকুমের উপর কোন রকমের প্রভাব গ্রহণযোগ্য নয় ।
শব্দগত অর্থে তাকলীদ হচ্ছে যাচাই-বাছাই না করে অন্যকে অনুসরণ করা । বলা যায়, সে তাকে এভাবে এভাবে অনুকরণ করেছে অর্থাৎ সে তাকে যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনুকরণ করেছে । ফিকাহ্ অনুযায়ী তাকলীদ হচ্ছে, অন্যের বক্তব্য কোন দলিল বা যুক্তি প্রমাণ দিয়ে বিচার না করে অনুসরণ করা যেমন, কোন উম্মি ব্যক্তির কোন মুজতাহিদের মতামতকে গ্রহণ করা বা কোন মুজতাহিদের তার সমমর্যাদার কোন মুজতাহিদের ইজতিহাদ মেনে চলা।
শরীয়াহ আইনে তাকলীদের প্রমাণঃ
শরীয়াহ আইনানুযায়ী তাকলীদ সকল মুসলমানের জন্য অনুমোদিত । আল্লাহ (সুব:) বলেনঃ
“যদি তোমরা না জান তাহলে জ্ঞানীদের (আহল আল-জিকির) নিকট জিজ্ঞাসা কর ।”(সূরা আম্বিয়া: ০৭)
আল্লাহ (সুব:) যার জ্ঞান নেই তাকে যার জ্ঞান আছে তার কাছ থেকে জানার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। উপরোক্ত আয়াতটি মুশরিকদের উদ্দেশ্যে নাযিল হয়। মুশরিকদের অভিযোগ ছিল মানুষ স্বয়ং কখনও নবী-রাসূল হতে পারেনা। তাদের অভিযোগের জবাবে আল্লাহ (সুব:) মুশকিদেরকে আহলে কিতাবদের কাছ থেকে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ সম্পর্কে জানতে বলেন যে তারা মানুষ ছিল কিনা। কেননা মুশরিকরা এ ব্যাপারে ছিল অজ্ঞ এবং আহলে কিতাবরা এ ব্যাপারে ছিল জ্ঞাত। এই আয়াতের বক্তব্য সাধারণ এবং কোন বিশেষ কারণ বা বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত নয় বরঞ্চ সাদামাটাভাবে যারা জানেনা তাদের প্রতি, যারা জানে তাদের কাছ থেকে জানার জন্য তাগিদ। ফাসআ’লু (জিজ্ঞাসা কর) শব্দটি সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে অর্থ্যাৎ আল্লাহ (সুব:) পূর্ববর্তীদের নিকট মানুষ ছাড়া কাউকে নবী হিসাবে পাঠাননি এ বিষয়টি জানার জন্য জিজ্ঞাসা কর । শব্দটি জ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত, বিশ্বাসের সাথে নয় ।
সন্দেহাতীতভাবে বর্ণিত যে, আল-শাবী বলেন, রাসূল (সা:) এর ছয়জন সাহাবী ছিলেন যারা ফিকাহ সম্পর্কিত বিষয়ে রায় দিতেন । এই ছয়জন হলেন ইবনে মাসুদ (রা:), উমর বিন খাত্তাব (রা:), আলী ইবনে আবি তালিব (রা:), যায়িদ বিন সাবিত (রা:), উবাই ইবনে কা’ব (রা:) এবং আবু মুসা (রা:)। এদের মধ্যে তিন জন অন্য তিন জনের মতামতকে প্রাধান্য দিতেন। ইবনে মাসুদ উমার (রা:) এর রায়কে প্রধান্য দিতেন, আবু মুসা (রা:) আলী (রা:) এর রায়কে প্রধান্য দিতেন, যায়িদ (রা:) উবাই ইবনে কা’ব (রা:) এর রায়কে প্রাধান্য দিতেন। এ থেকে আমরা দেখতে পাই সাধারণ মুসলমানরা যেমনি সাহাবীদের অনুকরণ করত তেমনি সাহাবীদের কেউ কেউ অন্য সাহাবীদের অনুকরণ করতেন ।
তাকলীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত মাপকাঠি:
মুসলমানদের সামনে যখন কোন বিষয় উপস্থাপিত হয় তা না জেনে পালন করার অনুমতি নেই যেহেতু আল্লাহ (সুব:) এর উপাসনা অজ্ঞভাবে নয়, জেনে এবং বুঝে করতে হবে। আল্লাহ (সুব:) এর ঐসব নিয়ম-কানুন জানা মুসলমানদের জন্য ফরয যা কোন কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয়। কারণ মুসলমানদের এগুলো সম্পর্কে জ্ঞান না থাকলে উক্ত বিষয় পালন করা সম্ভব নয়। মুসলমানদের এ জ্ঞান দরকার আল্লাহর হুকুম প্রনয়ণ ও সে অনুযায়ী কাজ করার জন্য ।
আল্লাহ (সুব:) বলেন, “তোমরা যদি না জান তবে জ্ঞানীদের নিকটজিজ্ঞাসা কর ।” (সূরা আম্বিয়াঃ ০৭)
যখন কোন বিষয়ে দুই মুজতাহিদের ভিন্ন ভিন্ন মতামতের কারণে মতানৈক্য দেখা দেয়, তখন মুকাল্লিদ ব্যক্তির কোন একটি পছন্দ করার সুযোগ নেই । কেউ কেউ মনে করেন মুকাল্লিদ ব্যক্তির কাছে দুইটি মতামত একটি মতামতেরই শামিল । তারা মনে করেন, দুটির মধ্যে একটি তার নিজের ইচ্ছানুযায়ী অনুসরণ করার সুযোগ আছে, কিন্তু ব্যাপারটি এমন নয় কারণ মুসলমানদেরকে হুকুম শরীয়াহ মানার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যখন কোন মুকাল্লিদ দুই মুজতাহিদের মধ্যে সাংঘর্ষিক কোন মতামত পায় তখন নিজের সুবিধামত একটি গ্রহন করা নিষেধ । কারণ মুজতাহিদগণ দলিলের অনুসারী এবং দুজনেই দু সাংঘর্ষিক দলিল ব্যবহার করেছেন । মুসলমানদেরকে নিজের সুবিধামত একটি গ্রহন করা নিষেধ।
আল্লাহ (সুব:) বলেন, “তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হয়োনা ।” (সূরা নিসা: ১৩৫)
মুকাল্লিদ ব্যক্তির দুই দলিল তুলনা করা ছাড়া কোন উপায় নেই । মুকাল্লিদ ব্যক্তির নিকট দুই মুজতাহিদ মূলত দুটি দলিলের সমতূল্য । মুজতাহিদের জন্য যেমনি দু’টি সাংঘর্ষিক দলিল তুলনা করে দেখা বাধ্যতামূলক তেমনি মুকাল্লিদ ব্যক্তির জন্যও দুই সাংঘর্ষিক রায়কে তুলনা করে দেখতে হবে।
আল্লাহ (সুব:) বলেন, “(এবং) কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে উহা উপস্থিত কর আল্লাহ ও তার রাসূলের নিকট ।” (সূরা নিসা: ৫৯)
মুকাল্লিদ ব্যক্তির আল্লাহ ও রাসূলের কাছে ফিরে যাওয়া মানে এমন কিছু করা যা আল্লাহ (সুবহা:) ও রাসূল (সা:) কে খুশী করে। মুকাল্লিদ ব্যক্তির জন্য দুটি রায়কেই গ্রহন করা সম্ভব নয়, যেহেতু তা সাংঘর্ষিক । তুলনা না করে দুই মাযহাবের যে কোন একটি গ্রহণ করা মূলত ইচ্ছানুযায়ী পছন্দ করার শামিল, যা আল্লাহ (সুবহা:) ও রাসূল (সা:) এর কাছে ফিরে যাওয়ার বিপরীত।
যার উপর ভিত্তি করে মুকাল্লিদ একজন মুজতাহিদের উপর অন্যজনকে প্রধান্য দেয়, অথবা কোন এক হুকুম থেকে অন্য হুকুমকে প্রধান্য দেয় তা হচ্ছে জ্ঞান এবং বুঝার ক্ষমতা। এজন্য মুকাল্লিদ ব্যক্তি মুজতাহিদের জ্ঞান ও বিশ্বাসযোগ্যতা পরিমাপ করবে কারণ স্বাক্ষীর সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা একটি শর্ত। মুজতাহিদ যখন হুকুম শরীয়াহ সংজ্ঞায়িত করেন এটাই তার সাক্ষ্য, কেননা তার মাধ্যমে আমরা ঐ হুকুম সম্পর্কে অবহিত হই। সুতরাং কোন হুকুম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে ঐ হুকুম যিনি শিক্ষা দেন তার সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ এবং যিনি ইজতিহাদ করে হুকুম বের করেন তার সততা অতীব প্রয়োজনীয় । জ্ঞানই হচ্ছে সঠিক যোগ্যতা যার ভিত্তিতে তুলনা করা যায় । যিনি মনে করেন ইমাম শাফী (র:) তুলনামূলক বেশী জ্ঞানী ছিলেন এবং তার মাযহাব অপেক্ষাকৃত বেশি ঠিক, সে তার নিজের ইচ্ছানুযায়ী অন্য মাযহাব গ্রহণ করতে পারেনা । মুকাল্লিদ ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন মাযহাব থেকে তার কাছে যা বেশি গ্রহনযোগ্য মনে হয় তা পছন্দ ও গ্রহণ করার অধিকার নেই ।
মাযহাব পরিবর্তন:
আল্লাহ (সুব:) আমাদের কোন মুজতাহিদ, ইমাম বা মাযহাব অনুসরণ করার নির্দেশ করেননি, বরং তিনি (সুব:) আমাদেরকে হুকুম শরীয়াহ পালন করতে আদেশ করেছেন । তিনি (সুব:) আমাদের রাসূল (সা:) যা বলেছেন তা মানতে এবং যা নিষেধ করেছেন তা ত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছেন ।
আল্লাহ (সুব:) বলেন, “এবং রাসূল তোমাদের যা দেয় তা গ্রহন কর এবং যা করতে নিষেধ করে তা থেকে বিরত থাক।” (সূরা হাশর: ০৭)
তাই শরীয়াহ আমাদের আল্লাহ (সুব:) এর নিয়ম অনুসরণের কথা বলে, কোন মানুষের কথা নয় । বাস্তবে তাকলিদ মুসলমানদের নির্দিষ্ট মুজতাহিদ যারা ইমাম হিসাবে গৃহীত তাদের ইজতিহাদ অনুসরণ করতে বলে এবং নিজেদের মাজহাব হিসেবে ঐ মুজতাহিদের ইজতিহাদকৃত নিয়ম-কানুন প্রনয়ণ করতে বলে। যার কারণে মুসলমানদের মধ্যে শাফী, হানাফী, মালিকি, হাম্বলী ইত্যাদি মাযহাব রয়েছে। যদিও মুসলমানরা এসকল মুজতাহিদের ইজতিহাদকৃত শরীয়াহ আইন অনুসরণ করে, এটা করা তাদের জন্য আইনসিদ্ধ কারণ এটা মূলত শরীয়াহ আইনেরই অনুসরণ । যারাই মাযহাব অনুসরণ করে তাদের বোঝা উচিত তারা শুধুমাত্র আল্লাহর আইনই অনুসরণ করে যা ঐ সকল ইমাম কর্তৃক ইজতিহাদকৃত ।
মাযহাব অনুসরণের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য। অন্যদিকে মাযহাব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অন্য নিয়ম। যদি কেউ কোন ইজতিহাদ গ্রহণ করেন কিন্তু তা পালন করা শুরু না করেন তাহলে তিনি তা পরিবর্তন করতে পারেন শুধুমাত্র আল্লাহর (সুব:) এর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। যদি তিনি উক্ত বিষয় পালন করা শুরু করেন তাহলে তা তার জন্য আল্লাহর (সুবহা:) হুকুম হয়ে যায়। তখন তার জন্য অন্য হুকুম পালন করা বৈধ নয় । তবে যদি দ্বিতীয় ইজতিহাদ গ্রহনযোগ্য দলিলের উপর ভিত্তি করে হয় এবং প্রথম ইজতিহাদ দলিলের উপর ভিত্তি করে না হয় তাহলে তিনি তা পরির্বতন করতে পারেন। অথবা যদি এমন হয় যে দ্বিতীয় ইজতিহাদের দলিলসমূহ অধিক গ্রহনযোগ্য এবং তা তাকে প্রভাবিত করে তাহলেও তিনি প্রথম ইজতিহাদ পরিহার করতে পারেন। এটা মুজতাহিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যখন তিনি নিজের ইজতিহাদের দলিলের চেয়ে অন্য ইজতিহাদের দলিল অধিক গ্রহনযোগ্য মনে করেন তখন নিজের ইজতিহাদ পরিহার করতে পারেন। অন্য কোনভাবে মুকাল্লিদ ব্যক্তির সে যে মাযহাব পালন করে আসছে তা পরিবর্তনের সুযোগ নেই ।
অন্য কোন হুকুমের ক্ষেত্রে যা এখনও সে পালন করেনি সেক্ষেত্রে অন্য মুজতাহিদের ইজতিহাদ পালন করতে পারেন যা ইজমা-ই-সাহাবা কর্তৃক গৃহীত । যখন কোন মুকাল্লিদ ব্যক্তি কোন মাযহাব নির্ধারণ করেন এবং বলেন (উদাহরণ স্বরূপ) আমি শাফী বা হানাফী মাযহাব অনুসরণ করি, সেক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে তিনি ঐ মাযহাব ব্যতীত অন্য কোন মুজতাহিদের অনুসরণ করতে পারবেননা যেসব বিষয় তিনি স্বীয় মাযহাবের অনুশীলন করে আসছেন। যেসব বিষয় তিনি অনুশীলন করেননি সেসব ক্ষেত্রে অন্য মুজতাহিদকে অনুসরণ করতে পারবেন ।
মুকাল্লিদ কোন মুজতাহিদ, ইমাম বা মাযহাব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ঐ হুকুমের সাথে সম্পর্কিত যাবতীয় ইস্যু পরিহার করতে হবে। সবগুলো ইস্যু পরিহার না করলে হুকুমটি পরিহার করা যায়না কারণ ঐসবগুলো ইস্যু মিলেই ঐ একটি মূল ইস্যু বা হুকুম। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নামাযের সাথে সম্পর্কিত ওযু ও অন্যান্য বিষয়। যে শাফী মাযহাব অনুসরণ করে তার জন্য নামাযের ক্ষেত্রে হানাফীর ওযুর হুকুম পালন অর্থ্যাৎ মহিলাদের স্পর্শ করলে ওযু ভঙ্গ হয়না এই নীতি অনুসরণ করে নামায পড়া বৈধ নয়। অন্যভাবে বলা যায় সূরা ফাতিহা পড়া নামাযের রুকন নয়- এটি হানাফী মত যা অনুসরণ করে শাফী মাযহাব অনুযায়ী নামায পড়া বৈধ নয়। কোন হুকুম গ্রহণ বা পরিহারের ক্ষেত্রে অন্য মাযহাব অনুযায়ী গৃহীত হুকুমের উপর কোন রকমের প্রভাব গ্রহণযোগ্য নয় ।