ইজতিহাদ
ইজতিহাদ
ইজতিহাদের সংজ্ঞা:
“শরয়ী আহকাম থেকে জন অনুসন্ধানের জন্য সম্পূর্ণ শক্তি এমনভাবে ব্যয় করে দেয়া যে, নিজের মধ্যেই তার থেকেও আরো বেশি চেষ্টা করার ক্ষেত্রে অপারগতা অনুভব হয়।”
এই পূর্ণ সংজ্ঞা থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সাব্যস্ত হয়।
১। ‘এমনভাবে পূর্ণ শক্তি ব্যয় করা যে নিজের মধ্যেই অক্ষমতা অনুভব হয়।’ এবং এর দ্বারা সামান্য কোন চিন্তা-ভাবনা বের হয়ে যায়।
২। ‘জন’ (অস্পটতা) এর উল্লেখ করার দ্বারা ‘কতয়ী’ বা অকাট্য বিষয়সমূহ বের হয়ে গেছে। অর্থাৎ ইজতেহাদ কেবলমাত্র জন্নী দলীল-প্রমাণের মধ্যে হতে পারে। এর দ্বারা আকীদা সংশ্লিষ্ট বিষয়ও বের হয়ে যায়। কেননা আকীদার মধ্যে জন্নী দলীলের কোন অবকাশ নেই। বরং এক্ষেত্রে কেবলমাত্র ‘কতয়ী’ বা অকাট্য দলীলই গ্রহণযোগ্য হয়।
৩। ‘শরয়ী আহকাম’ বলার দ্বারা কোন চিন্তাপ্রসূত বা আলমের স্বত্ত্বাগত রায় বা বক্তব্য এই মুয়ামালার (মামলার) বাইরে। অন্য কথায় কোন শরয়ী দলীল ব্যতীত যে কারোই রায় হোক না কেন, ইজতিহাদের মধ্যে তার কোন স্থান নেই।
ইজতিহাদের দলীল-প্রমাণ
ইজতিহাদ ফরজে কিফায়া। কেননা এটি ছাড়া জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুম সম্পর্কে অবগত হওয়া যায় না। আর আল্লাহর হুকুমের সম্পর্কে অবগত হওয়া ব্যতীত তার উপর আমল করাটাও অসম্ভব। সুতরাং এই বিষয়টাও নাজায়েজ যে নতুন কোন অবস্থা সামনে আসলো বা কোন ঘটনা সংঘটিত হলো কিন্তু তার শরয়ী হুকুম না জানার কারণে তার উপর আমল করা গেল না। কেননা, মুসলমানদের উপর এ বিষয়টি আবশ্যক যে, তারা জীবনের সকল কার্যাবলী শরীয়া অনুযায়ী বাস্তবায়ন করবে। একারণেই জীবনে নতুন নতুন বিষয়াবলীর শরয়ী আহকাম খুঁজে বের করার জন্য প্রত্যেক জমানায় মুজতাহিদ থাকা আবশ্যক।
ইজতিহাদের দলীল:
“হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. কে যখন মহানবী সা. কাজী নিয়োগ করে ইয়ামানে প্রেরণ করেছিলেন তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে মুয়াজ তুমি লোকদের মাঝে কি দিয়ে ফায়সালা ও মিমাংসা করবে? হযরত মুয়াজ রা. বলেছিলেন, মহান আল্লাহর কিতাব কুরআন দ্বারা। এরপর রাসূল স. আবার জিজ্ঞেস করলেন, যদি কোন বিষয় কুরআনে না পাও তবে কি দিয়ে ফায়সালা করবে? মুয়াজ রা. বললেন, তাহলে আল্লাহর প্রেরিত রাসূলের সুন্নাহ দ্বারা ফায়সালা করবো। মহানবী সা. আবারও জিজ্ঞেস করলেন, যদি এর মাঝেও সমাধান না পাও? তখন হযরত মুয়াজ রা. বললেন, তাহলে আমি আমার বুদ্ধি দ্বারা এগুলোর মধ্যে ইজতিহাদ করে ফায়সালা প্রদান করবো। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, সেই মহান আল্লাহর প্রশংসা যিনি তার রাসূলকে এমন প্রতিনিধি দান করেছেন, যার উপর আল্লাহ এবং তার রাসূল সন্তুষ্ট।” (আবূ দাউদ)
অন্য রিওয়ায়াতে আছে-
“যখন কোন মুজতাহিদ সঠিকভাবে ইজতিহাদ করে ফায়সালা প্রদান করে এবং তার ফায়সালাটি সঠিক হয় তাহলে তার জন্য দু’টি সওয়াব। আর যখন তার ফায়সালা ভুল হবে তখন তার জন্য একটি সওয়াব।” (বুখারী ও মুসলিম)
এছাড়াও ইজতিহাদের উপর সাহাবায়ে কিরামের ইজমা প্রতিষ্ঠিত আছে। কেননা, তারা নিজেরা অনেক ক্ষেত্রেই অধিকহারে ইজতিহাদ করেছিলেন।
লক্ষণীয় যে, ইজতিহাদ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, জন্নী শরয়ী দলীল থেকে ইসতিম্বাত করা। কোন হুকুমের এমন কোন নতুন মাসআলায় সমতা বিধান নয়, যা তার মধ্যেই আসে।
উদাহরণ:
মহিলাদের মজলিস, উম্মতের সদস্য হওয়ার বৈধতা, ওকালাতের (প্রতিনিধির) হুকুমের এই মাসআলার উপর সমতাবিধানের দ্বারা সাব্যস্ত। এটা এজন্য যে ওকালাত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, কারো কোন মুয়ামালার (মামলার) মধ্যে প্রতিনিধিত্ব করা। আর মজলিসে সদস্যের বাস্তবতাও হলো জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা। সুতরাং যেহেতু মহিলারা কাউকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে উকীল নিযুক্ত করতে পারেন একইভাবে তারা কারো উকীল হতেও পারবেন। আর এর দ্বারা তাদের মজলিসে উম্মতের সদস্য হওয়ার বৈধতাও প্রমাণিত হয়। এই ধারাবাহিকতাকে ইজতিহাদ বলা হয় না, বরং এটি ‘কাযা’। অর্থাৎ এমন একটি মাসআলা যার উপর বিদ্যমান হুকুমকে সমতাবিধান করা হয়েছে।
ইজতিহাদের শর্তাবলী
১। আরবী ভাষা জ্ঞান ।
যেহেতু শরয়ী নুসূসসমূহ আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর শরয়ী হুকুমসমূহ এই নুসূস থেকেই বের করা হয়েছে। এজন্য এটা পরিষ্কার বিষয় যে, আরবী ভাষায় এই পরিমাণ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, যাতে করে শরয়ী চেতনাকে খুব ভালোভাবে এবং সার্বিকভাবে অনুধাবন করা যায়। অর্থাৎ খেতাবের মধ্যে শব্দসমূহের আভিধানিক অর্থ, কথার ধরণ, নাহু এবং সরফ এর কায়দাসমূহ, খাস ও আম, মতলক ও মুকাইয়াদ, বয়ান ও মুবাইয়ান, মুজমাল ও তাফসীল, হাকীকত ও মাজায, আমর ও নাহী, নাসেখ ও মানসুখ, হুরুফ ও আলফাজের প্রকারসমূহ, আজনাসে কালাম, দালালতে আলফাজ ইত্যাদি।
২। শরয়ী ইলমের জ্ঞান ।
অর্থাৎ দলীল-প্রমাণাদী, শরয়ী হুকুম এবং তার প্রকারভেদ, কিয়াস ও ইল্লত, জমা ও তারজীহ এর প্রকার, জরাহ এবং তা’দীলের ইলম, আসবাবে নুযূল, সুন্নাহ্ এবং তার প্রকারসমূহের জ্ঞান ইত্যাদি।
মুজতাহিদের প্রকারভেদ
মুজতাহিদ তিন প্রকার।
১. মুজতাহিদে মাসআলা
২. মুজতাহিদে মাযহাব
৩. মুজতাহিদে মুতলাক
১। মুজতাহিদে মাসআলা
“যারা কতিপয় মাসআলা সম্পর্কে ইজতিহাদ করলো।” তার জন্য কেবল সেই মাসআলা এবং সে সম্পর্কিত আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থের অবগতি প্রয়োজন।
উদাহরণ: সে যদি ক্লোনিং এর মাসআলা সম্পর্কে ইজতিহাদ করতে চায় তাহলে প্রথমে তাকে এর হাকীকত বা বাস্তবতা গভীরভাবে জানতে হবে। অত:পর তাকে সেই সকল নুসূস এর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে যা এই মাসআলার সাথে সম্পর্ক রাখে।
তাকে এ বিষয়ক নুসূসসমূহ গভীরভাবে বুঝতে হবে যাতে করে সে ক্লোনিং এর হুকুমকে ইসতিম্বাত করতে পারে। তার জন্য এ বিষয় বহির্ভূত প্রকার সম্পর্কে অবগত হওয়াটা আবশ্যক নয়। কঠিন পরিশ্রম, সুদৃঢ় ইচ্ছা, সীমাহীন শৃংখলা ও ধারাবাহিকতার দ্বারাই কেউ এই পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।
২। মুজতাহিদে মাযহাব
“যারা ইজতিহাদের তরীকা বা উসূলের মধ্যে স্বীয় ইমামের অনুসরণ করেন। কিন্তু শাখাগত বিষয়ে সেই সকল উসূলের আলোকে নিজেও কোন হুকুম-আহকাম ইসতিম্বাত করেন।” এছাড়াও তাকে স্বীয় মাযহাবের সকল আহকাম, তার প্রমাণাদি এবং তার দ্বারা ইসতিম্বাতের কাইফিয়্যাত সম্পর্কেও অবগত থাকতে হবে।
৩। মুজতাহিদে মুতলাক
“যারা ইসলামী শরীয়তের উপর ব্যাপকভাবে একাধিক বিভিন্ন মাসআলার মধ্যে ইজতিহাদ করতে সক্ষম হন এবং তারা নিজেদের উসূলও নিজেরাই নির্দিষ্ট করে নিতে পারেন।”
ইজতিহাদের জন্য উপরে উল্লেখিত শর্তাবলী মুজতাহিদে মুতলাকের জন্য আবশ্যক। তবে এর অর্থ এই নয় যে তাদের ঐসকল ইলম ও বিষয়াবলী মুখস্ত ও ঠোটস্ত থাকতে হবে। এটাও নয় যে, সকল আহকাম সমূহই আয়ত্ব করে নিতে হবে। কেননা, এমনটি মানবিক শক্তির সাধ্যের বাইরে। অন্য কথায় এটা আবশ্যক নয় যে, তাদেরকে ঐসকল ইলম এবং বিষয়ের আলেম হতে হবে। বরং উদ্দেশ্য কেবল এতটুকু যে, ঐসকল বিষয় সম্পর্কে অবগত থাকা যাতে করে তার যে কোন একটি বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে তার গভীর পর্যন্ত অনুধাবন করতে পারেন এবং তার দ্বারা কোন একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। এটা অনেক কঠিন তবে অসম্ভব নয়।
এখানে এটা বলা যাবে না যে, ইজহিতাদের এমন বিশ্লেষণ করা (Divisibility) কিভাবে করা সম্ভব? কেননা হয়তো বান্দার মধ্যে ইজতিহাদের যোগ্যতা থাকবে বা থাকবে না। এটা এজন্য যে এই বিশ্লেষণ আবওয়াবে ফিকাহ্ এর হিসেবে নয় বরং ইসতিম্বাতের শক্তির আলোকে। এই কারণে যে, মুজতাহিদের জন্য বিশেষ কোন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দলীল-প্রমাণ শ্রবণ ও অনুধাবন করা সহজ হতে পারে, যার দ্বারা সে ইজতিহাদ করতে সক্ষম হবে। একই সময়ে অন্য একটি বিষয়ে দলীল-প্রমাণের মধ্যে কাঠিন্য থাকা ও তা অবোধগম্য হওয়ার কারণে হয়তো সেগুলো শ্রবণ ও অনুধাবন করতে তিনি সক্ষম হবেন না এবং ইজতিহাদ অসম্ভব হবে। তবে এ কারণে তার অন্য ইজতিহাদগুলোকে বাতিল বলা যাবে না।
মুজতাহিদে মুতলাকের জন্য এটা আবশ্যক নয় যে তিনি প্রত্যেক মাসআলার মধ্যে ইজতিহাদ করবেন। বরং তার জন্য এটাও জায়েজ আছে যে তিনি অন্য কোন মুজতাহিদের তাকলীদ (অনুসরণ) করবেন। এ বিষয়টি সাহাবায়ে কিরামের ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত যে তাদের মধ্যে অনেকেই নিজে ইজতিহাদের যোগ্যতা ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন বিষয়ে অন্যের তাকলীদ বা অনুসরণ করতেন। তবে হ্যাঁ, মুজতাহিদ যদি ইজতিহাদ করে নেয় এবং হুকুমও উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হন তাহলে এমন অবস্থায় তার উপর নিজের কৃত ইজতিহাদের অনুসরণ ও অনুগত্য আবশ্যক হবে এবং তা পরিত্যাগ করা তার জন্য বৈধ হবে না। তবে নিম্নোক্ত চারটি অবস্থা ব্যতীত।
১. যখন ইমাম বা খলীফা কোন হুকুমের ব্যাপারে নির্দেশনা জারী করেন। তখন এই অবস্থায় মুজতাহিদের জন্য নিজের ইজতিহাদ পরিত্যাগ করে খলীফার আনুগত্য করা এবং তার হুকুমের অনুসরণ করাটা ওয়াজিব হয়ে যায়। কেননা শরয়ী মূলনীতি হলো-
“ইমামের হুকুম মতবিরোধ নিরসন করে।”
২. যখন মুজতাহিদের নিকট এ বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে যে, তার দলীল দূর্বল ছিল এবং অন্য মুজতাহিদের দলীল শক্তিশালী। তখন এই অবস্থায় তার জন্য তার নিজের ইজতিহাদ পরিত্যাগ করাটা ওয়াজিব।
৩. যদি তার এই সন্দেহ ও ধারণা হয় যে, অন্য মুজতাহিদ মা’লুমাত আয়ত্ব করার ব্যাপারে অথবা বাস্তবতা এবং দলীল অনুধাবনের ক্ষেত্রে বেশী গভীরতা ও পারঙ্গমতা লাভ করেছেন। অর্থাৎ তার ইজতিহাদের উপর তার বেশী ভরসা ও দৃঢ়তা রয়েছে। তাহলে এই অবস্থায় প্রথম মুজতাহিদের জন্য স্বীয় ইজতিহাদকে পরিত্যাগ করা জায়েজ হবে।
৪. যখন নিজের ইজতিহাদ পরিত্যাগ করা হলে মুসলমানদের ঐক্য বজায় থাকে। যেমন হযরত উসমান রা. খিলাফতের আসনে বসার সময় নিজের ইজতিহাদ পরিত্যাগ করে হযরত আবূ বকর ও হযরত উমর রা. এর ইজতিহাদের উপর আমল করার ব্যাপারে বায়আত গ্রহণ করেছিলেন। যাতে করে উম্মতের ঐক্য বজায় থাকে।
ইজতিহাদের সংজ্ঞা:
“শরয়ী আহকাম থেকে জন অনুসন্ধানের জন্য সম্পূর্ণ শক্তি এমনভাবে ব্যয় করে দেয়া যে, নিজের মধ্যেই তার থেকেও আরো বেশি চেষ্টা করার ক্ষেত্রে অপারগতা অনুভব হয়।”
এই পূর্ণ সংজ্ঞা থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সাব্যস্ত হয়।
১। ‘এমনভাবে পূর্ণ শক্তি ব্যয় করা যে নিজের মধ্যেই অক্ষমতা অনুভব হয়।’ এবং এর দ্বারা সামান্য কোন চিন্তা-ভাবনা বের হয়ে যায়।
২। ‘জন’ (অস্পটতা) এর উল্লেখ করার দ্বারা ‘কতয়ী’ বা অকাট্য বিষয়সমূহ বের হয়ে গেছে। অর্থাৎ ইজতেহাদ কেবলমাত্র জন্নী দলীল-প্রমাণের মধ্যে হতে পারে। এর দ্বারা আকীদা সংশ্লিষ্ট বিষয়ও বের হয়ে যায়। কেননা আকীদার মধ্যে জন্নী দলীলের কোন অবকাশ নেই। বরং এক্ষেত্রে কেবলমাত্র ‘কতয়ী’ বা অকাট্য দলীলই গ্রহণযোগ্য হয়।
৩। ‘শরয়ী আহকাম’ বলার দ্বারা কোন চিন্তাপ্রসূত বা আলমের স্বত্ত্বাগত রায় বা বক্তব্য এই মুয়ামালার (মামলার) বাইরে। অন্য কথায় কোন শরয়ী দলীল ব্যতীত যে কারোই রায় হোক না কেন, ইজতিহাদের মধ্যে তার কোন স্থান নেই।
ইজতিহাদের দলীল-প্রমাণ
ইজতিহাদ ফরজে কিফায়া। কেননা এটি ছাড়া জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুম সম্পর্কে অবগত হওয়া যায় না। আর আল্লাহর হুকুমের সম্পর্কে অবগত হওয়া ব্যতীত তার উপর আমল করাটাও অসম্ভব। সুতরাং এই বিষয়টাও নাজায়েজ যে নতুন কোন অবস্থা সামনে আসলো বা কোন ঘটনা সংঘটিত হলো কিন্তু তার শরয়ী হুকুম না জানার কারণে তার উপর আমল করা গেল না। কেননা, মুসলমানদের উপর এ বিষয়টি আবশ্যক যে, তারা জীবনের সকল কার্যাবলী শরীয়া অনুযায়ী বাস্তবায়ন করবে। একারণেই জীবনে নতুন নতুন বিষয়াবলীর শরয়ী আহকাম খুঁজে বের করার জন্য প্রত্যেক জমানায় মুজতাহিদ থাকা আবশ্যক।
ইজতিহাদের দলীল:
“হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. কে যখন মহানবী সা. কাজী নিয়োগ করে ইয়ামানে প্রেরণ করেছিলেন তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হে মুয়াজ তুমি লোকদের মাঝে কি দিয়ে ফায়সালা ও মিমাংসা করবে? হযরত মুয়াজ রা. বলেছিলেন, মহান আল্লাহর কিতাব কুরআন দ্বারা। এরপর রাসূল স. আবার জিজ্ঞেস করলেন, যদি কোন বিষয় কুরআনে না পাও তবে কি দিয়ে ফায়সালা করবে? মুয়াজ রা. বললেন, তাহলে আল্লাহর প্রেরিত রাসূলের সুন্নাহ দ্বারা ফায়সালা করবো। মহানবী সা. আবারও জিজ্ঞেস করলেন, যদি এর মাঝেও সমাধান না পাও? তখন হযরত মুয়াজ রা. বললেন, তাহলে আমি আমার বুদ্ধি দ্বারা এগুলোর মধ্যে ইজতিহাদ করে ফায়সালা প্রদান করবো। তখন রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, সেই মহান আল্লাহর প্রশংসা যিনি তার রাসূলকে এমন প্রতিনিধি দান করেছেন, যার উপর আল্লাহ এবং তার রাসূল সন্তুষ্ট।” (আবূ দাউদ)
অন্য রিওয়ায়াতে আছে-
“যখন কোন মুজতাহিদ সঠিকভাবে ইজতিহাদ করে ফায়সালা প্রদান করে এবং তার ফায়সালাটি সঠিক হয় তাহলে তার জন্য দু’টি সওয়াব। আর যখন তার ফায়সালা ভুল হবে তখন তার জন্য একটি সওয়াব।” (বুখারী ও মুসলিম)
এছাড়াও ইজতিহাদের উপর সাহাবায়ে কিরামের ইজমা প্রতিষ্ঠিত আছে। কেননা, তারা নিজেরা অনেক ক্ষেত্রেই অধিকহারে ইজতিহাদ করেছিলেন।
লক্ষণীয় যে, ইজতিহাদ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, জন্নী শরয়ী দলীল থেকে ইসতিম্বাত করা। কোন হুকুমের এমন কোন নতুন মাসআলায় সমতা বিধান নয়, যা তার মধ্যেই আসে।
উদাহরণ:
মহিলাদের মজলিস, উম্মতের সদস্য হওয়ার বৈধতা, ওকালাতের (প্রতিনিধির) হুকুমের এই মাসআলার উপর সমতাবিধানের দ্বারা সাব্যস্ত। এটা এজন্য যে ওকালাত দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, কারো কোন মুয়ামালার (মামলার) মধ্যে প্রতিনিধিত্ব করা। আর মজলিসে সদস্যের বাস্তবতাও হলো জনগণের প্রতিনিধিত্ব করা। সুতরাং যেহেতু মহিলারা কাউকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে উকীল নিযুক্ত করতে পারেন একইভাবে তারা কারো উকীল হতেও পারবেন। আর এর দ্বারা তাদের মজলিসে উম্মতের সদস্য হওয়ার বৈধতাও প্রমাণিত হয়। এই ধারাবাহিকতাকে ইজতিহাদ বলা হয় না, বরং এটি ‘কাযা’। অর্থাৎ এমন একটি মাসআলা যার উপর বিদ্যমান হুকুমকে সমতাবিধান করা হয়েছে।
ইজতিহাদের শর্তাবলী
১। আরবী ভাষা জ্ঞান ।
যেহেতু শরয়ী নুসূসসমূহ আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর শরয়ী হুকুমসমূহ এই নুসূস থেকেই বের করা হয়েছে। এজন্য এটা পরিষ্কার বিষয় যে, আরবী ভাষায় এই পরিমাণ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, যাতে করে শরয়ী চেতনাকে খুব ভালোভাবে এবং সার্বিকভাবে অনুধাবন করা যায়। অর্থাৎ খেতাবের মধ্যে শব্দসমূহের আভিধানিক অর্থ, কথার ধরণ, নাহু এবং সরফ এর কায়দাসমূহ, খাস ও আম, মতলক ও মুকাইয়াদ, বয়ান ও মুবাইয়ান, মুজমাল ও তাফসীল, হাকীকত ও মাজায, আমর ও নাহী, নাসেখ ও মানসুখ, হুরুফ ও আলফাজের প্রকারসমূহ, আজনাসে কালাম, দালালতে আলফাজ ইত্যাদি।
২। শরয়ী ইলমের জ্ঞান ।
অর্থাৎ দলীল-প্রমাণাদী, শরয়ী হুকুম এবং তার প্রকারভেদ, কিয়াস ও ইল্লত, জমা ও তারজীহ এর প্রকার, জরাহ এবং তা’দীলের ইলম, আসবাবে নুযূল, সুন্নাহ্ এবং তার প্রকারসমূহের জ্ঞান ইত্যাদি।
মুজতাহিদের প্রকারভেদ
মুজতাহিদ তিন প্রকার।
১. মুজতাহিদে মাসআলা
২. মুজতাহিদে মাযহাব
৩. মুজতাহিদে মুতলাক
১। মুজতাহিদে মাসআলা
“যারা কতিপয় মাসআলা সম্পর্কে ইজতিহাদ করলো।” তার জন্য কেবল সেই মাসআলা এবং সে সম্পর্কিত আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থের অবগতি প্রয়োজন।
উদাহরণ: সে যদি ক্লোনিং এর মাসআলা সম্পর্কে ইজতিহাদ করতে চায় তাহলে প্রথমে তাকে এর হাকীকত বা বাস্তবতা গভীরভাবে জানতে হবে। অত:পর তাকে সেই সকল নুসূস এর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে যা এই মাসআলার সাথে সম্পর্ক রাখে।
তাকে এ বিষয়ক নুসূসসমূহ গভীরভাবে বুঝতে হবে যাতে করে সে ক্লোনিং এর হুকুমকে ইসতিম্বাত করতে পারে। তার জন্য এ বিষয় বহির্ভূত প্রকার সম্পর্কে অবগত হওয়াটা আবশ্যক নয়। কঠিন পরিশ্রম, সুদৃঢ় ইচ্ছা, সীমাহীন শৃংখলা ও ধারাবাহিকতার দ্বারাই কেউ এই পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।
২। মুজতাহিদে মাযহাব
“যারা ইজতিহাদের তরীকা বা উসূলের মধ্যে স্বীয় ইমামের অনুসরণ করেন। কিন্তু শাখাগত বিষয়ে সেই সকল উসূলের আলোকে নিজেও কোন হুকুম-আহকাম ইসতিম্বাত করেন।” এছাড়াও তাকে স্বীয় মাযহাবের সকল আহকাম, তার প্রমাণাদি এবং তার দ্বারা ইসতিম্বাতের কাইফিয়্যাত সম্পর্কেও অবগত থাকতে হবে।
৩। মুজতাহিদে মুতলাক
“যারা ইসলামী শরীয়তের উপর ব্যাপকভাবে একাধিক বিভিন্ন মাসআলার মধ্যে ইজতিহাদ করতে সক্ষম হন এবং তারা নিজেদের উসূলও নিজেরাই নির্দিষ্ট করে নিতে পারেন।”
ইজতিহাদের জন্য উপরে উল্লেখিত শর্তাবলী মুজতাহিদে মুতলাকের জন্য আবশ্যক। তবে এর অর্থ এই নয় যে তাদের ঐসকল ইলম ও বিষয়াবলী মুখস্ত ও ঠোটস্ত থাকতে হবে। এটাও নয় যে, সকল আহকাম সমূহই আয়ত্ব করে নিতে হবে। কেননা, এমনটি মানবিক শক্তির সাধ্যের বাইরে। অন্য কথায় এটা আবশ্যক নয় যে, তাদেরকে ঐসকল ইলম এবং বিষয়ের আলেম হতে হবে। বরং উদ্দেশ্য কেবল এতটুকু যে, ঐসকল বিষয় সম্পর্কে অবগত থাকা যাতে করে তার যে কোন একটি বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে তার গভীর পর্যন্ত অনুধাবন করতে পারেন এবং তার দ্বারা কোন একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। এটা অনেক কঠিন তবে অসম্ভব নয়।
এখানে এটা বলা যাবে না যে, ইজহিতাদের এমন বিশ্লেষণ করা (Divisibility) কিভাবে করা সম্ভব? কেননা হয়তো বান্দার মধ্যে ইজতিহাদের যোগ্যতা থাকবে বা থাকবে না। এটা এজন্য যে এই বিশ্লেষণ আবওয়াবে ফিকাহ্ এর হিসেবে নয় বরং ইসতিম্বাতের শক্তির আলোকে। এই কারণে যে, মুজতাহিদের জন্য বিশেষ কোন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দলীল-প্রমাণ শ্রবণ ও অনুধাবন করা সহজ হতে পারে, যার দ্বারা সে ইজতিহাদ করতে সক্ষম হবে। একই সময়ে অন্য একটি বিষয়ে দলীল-প্রমাণের মধ্যে কাঠিন্য থাকা ও তা অবোধগম্য হওয়ার কারণে হয়তো সেগুলো শ্রবণ ও অনুধাবন করতে তিনি সক্ষম হবেন না এবং ইজতিহাদ অসম্ভব হবে। তবে এ কারণে তার অন্য ইজতিহাদগুলোকে বাতিল বলা যাবে না।
মুজতাহিদে মুতলাকের জন্য এটা আবশ্যক নয় যে তিনি প্রত্যেক মাসআলার মধ্যে ইজতিহাদ করবেন। বরং তার জন্য এটাও জায়েজ আছে যে তিনি অন্য কোন মুজতাহিদের তাকলীদ (অনুসরণ) করবেন। এ বিষয়টি সাহাবায়ে কিরামের ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত যে তাদের মধ্যে অনেকেই নিজে ইজতিহাদের যোগ্যতা ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন বিষয়ে অন্যের তাকলীদ বা অনুসরণ করতেন। তবে হ্যাঁ, মুজতাহিদ যদি ইজতিহাদ করে নেয় এবং হুকুমও উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হন তাহলে এমন অবস্থায় তার উপর নিজের কৃত ইজতিহাদের অনুসরণ ও অনুগত্য আবশ্যক হবে এবং তা পরিত্যাগ করা তার জন্য বৈধ হবে না। তবে নিম্নোক্ত চারটি অবস্থা ব্যতীত।
১. যখন ইমাম বা খলীফা কোন হুকুমের ব্যাপারে নির্দেশনা জারী করেন। তখন এই অবস্থায় মুজতাহিদের জন্য নিজের ইজতিহাদ পরিত্যাগ করে খলীফার আনুগত্য করা এবং তার হুকুমের অনুসরণ করাটা ওয়াজিব হয়ে যায়। কেননা শরয়ী মূলনীতি হলো-
“ইমামের হুকুম মতবিরোধ নিরসন করে।”
২. যখন মুজতাহিদের নিকট এ বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে যে, তার দলীল দূর্বল ছিল এবং অন্য মুজতাহিদের দলীল শক্তিশালী। তখন এই অবস্থায় তার জন্য তার নিজের ইজতিহাদ পরিত্যাগ করাটা ওয়াজিব।
৩. যদি তার এই সন্দেহ ও ধারণা হয় যে, অন্য মুজতাহিদ মা’লুমাত আয়ত্ব করার ব্যাপারে অথবা বাস্তবতা এবং দলীল অনুধাবনের ক্ষেত্রে বেশী গভীরতা ও পারঙ্গমতা লাভ করেছেন। অর্থাৎ তার ইজতিহাদের উপর তার বেশী ভরসা ও দৃঢ়তা রয়েছে। তাহলে এই অবস্থায় প্রথম মুজতাহিদের জন্য স্বীয় ইজতিহাদকে পরিত্যাগ করা জায়েজ হবে।
৪. যখন নিজের ইজতিহাদ পরিত্যাগ করা হলে মুসলমানদের ঐক্য বজায় থাকে। যেমন হযরত উসমান রা. খিলাফতের আসনে বসার সময় নিজের ইজতিহাদ পরিত্যাগ করে হযরত আবূ বকর ও হযরত উমর রা. এর ইজতিহাদের উপর আমল করার ব্যাপারে বায়আত গ্রহণ করেছিলেন। যাতে করে উম্মতের ঐক্য বজায় থাকে।