জাগরণ
একটি অনুন্নত ও অধঃপতিত জাতিকে কীভাবে উন্নত ও পুনর্জাগরিত করানো যায়, সে বিষয়ে অনেকের বিশ্লেষণের মধ্যেই চিন্তার দীনতা পরিলক্ষিত হয়। কেউ কেউ মনে করেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে একটি দেশ উন্নত বা পুনর্জাগরিত হতে পারে। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কাতার, কুয়েত বা সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রভৃতি দেশের অর্থনীতি বা মাথাপিছু আয় আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও চীনের মতো শক্তিশালী দেশগুলো থেকে বেশি হলেও জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে কাতার, কুয়েত বা সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে উন্নত বা পুনর্জাগরিত দেশ হিসেবে গণ্য হয় না -তারা বড়জোর ‘ধনী’ দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও চীন এই দেশগুলো উন্নত বা পুনর্জাগরিত হিসেবে সকলের কাছে স্বীকৃত।
এর কারণ হলো প্রকৃতপক্ষে উন্নতি বলতে কেবল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে বোঝায় না। সঠিক উন্নতি বা পুনর্জাগরণ বলতে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আদর্শিক উন্নয়নকে বোঝায়। কোনো জাতি যখন মানুষ, জীবন ও মহাবিশ্ব সম্বন্ধে স্বচ্ছ চিন্তা ধারণ করে, এই জীবনের আগে কী ছিল ও এই জীবনের পরে কী হবে - এসব বিষয়ে সামগ্রিকভাবে সঠিক চিন্তার সন্ধান পায়, তখন সে জাতি অধঃপতিত অবস্থা থেকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি খুঁজে পায়। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দীন, আদর্শিকভাবে হীন একটি জাতির সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন কখনোই হয় না:
إِنَّ اللَّهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ
আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে। [সূরা রা’দ: ১১]
মানুষ, জীবন ও মহাবিশ্ব সম্বন্ধে সামগ্রিক ধারণা প্রদানকারী কোনো মতাদর্শ (Ideology) -কে আঁকড়ে না ধরলে কোনো জাতি প্রকৃত অর্থে উন্নত হতে পারবে না। তবে ভুল মতাদর্র্শ (Ideology) বেছে নিলে এই উন্নতি এক ধরনের ভুল উন্নতি হিসেবে চিহ্নিত হবে। যেমন: আমেরিকা, ইউরোপ বা চীনের মতো দেশগুলো অবশ্যই উন্নত, তবে এই উন্নতি হলো ভুল উন্নতি। কেননা এদের মতাদর্শ হলো পুঁজিবাদ (বা চীনের ক্ষেত্রে, পুঁজিবাদমিশ্রিত সমাজতন্ত্র)। ইউরোপ-আমেরিকা জাতি রাষ্ট্রসমূহ ওই পুঁজিবাদকে তাদের মানুষ, জীবন ও মহাবিশ্বসংক্রান্ত যাবতীয় চিন্তার ভিত্তি হিসেবে নিয়েছে, জীবন ও রাষ্ট্রের সকল সমস্যা সেই ঐক্যবদ্ধ চিন্তার ভিত্তিতে সমাধান করে। এরূপ মতাদর্শভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার কারণে একটি পর্যায় পর্যন্ত তারা সাফল্য পায় - যেমনটা তারা ইতিমধ্যে অর্জনও করেছে। কিন্তু মানবরচিত এসব মতাদর্শের ভ্রান্তির কারণে ওই উন্নতি আসলে সঠিক বা স্থায়ী উন্নতি নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯১৭ কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রভূত উন্নতি অর্জন করেছিল, কিন্তু মতাদর্শের দুর্বলতার কারণে তা ১৯৯১ সালে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। একইভাবে, বর্তমানে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন-ধ্বনি শোনা যাচ্ছে -যেমনটা সোভিয়েত রাষ্ট্রে শোনা গিয়েছিল ১৯৮০-এর দশকে।
কারো কারো মনে অদ্ভুত ধারণা আছে যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির কারণে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী আছে, মতাদর্শ হিসেবে পুঁজিবাদের বিকাশের আগে ইউরোপ-আমেরিকা ছিল অজ্ঞানতা ও পশ্চাৎপদতার অন্ধকার নিদর্শন। পুঁজিবাদী মতাদর্শের ভিত্তিতে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর ইউরোপ-আমেরিকার মতাদর্শিক রাষ্ট্রগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি করেছে। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি কোনো জাতির জেগে ওঠার মাধ্যম নয় -বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান হলো কোনো জাতির বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে জেগে ওঠার ফলাফল।
কেউ কেউ মনে করে, বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অনুকরণে আইন ও রাষ্ট্রকাঠামো সাজিয়ে নিলে ওই উন্নত রাষ্ট্রের সমকক্ষতা অর্জন করা যাবে তথা উন্নতি লাভ করা যাবে। কিন্তু অন্য দেশ থেকে আইন বা ব্যবস্থা আমদানি করে যে উন্নতি লাভ করা যায় না, বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের সবদেশই এর অনস্বীকার্য প্রমাণ। বাংলাদেশসহ এই দেশগুলো সংবিধান, রাষ্ট্রকাঠামো, আইন-কানুন, বিধি-ব্যবস্থা সবই ইউরোপ-আমেরিকা থেকে (স্বেচ্ছায় কিংবা চাপে পড়ে) নকল করেছে। এমন কি, এখনো এসব দেশের সরকারগুলো বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা তথাকথিত দাতাদেশগুলো থেকে অহরহ নীতি, উপদেশ ধার করে যাচ্ছে। মুক্ত বাজার, গ্লোবালাইজেশন, গুড গভর্নেন্স -যখন যেটা পাচ্ছে চোখ বুঁজে নিয়ে নিচ্ছে। তবু উন্নতি অধরাই থেকে যায়।
এর কারণ হলো, ইউরোপ-আমেরিকার জাতি-রাষ্ট্রগুলো ওইসব আইন-কানুন, বিধি-ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তাদের নিজস্ব মতাদর্শিক চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাস থেকে। আর বাংলাদেশের মতো দেশগুলো মতাদর্শিক চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে কেবল ভৃত্যের মতো আইন-কানুন ও বিধি-ব্যবস্থার মধ্যে উন্নতি খুঁজছে। মূলত কোনো আইন বা ব্যবস্থাকে যদি মতাদর্শের ভিত্তিতে নেয়া হয় তাহলে এক ধরনের ফলাফল হয়; আবার যদি মতাদর্শকে না বুঝে, বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতার মধ্যে থেকে ওই একই আইন বা ব্যবস্থাকে গ্রহণ করা হয়, তাহলে আরেক ধরনের ফলাফল হয়। ইতিহাস একথার স্বচ্ছ সাক্ষী। ১৯২৪ সাল থেকে মুস্তফা কামাল পাশা তুরস্কের সর্বত্র তৎকালীন বিশ্বের সুপারপাওয়ার বৃটেনের অনুকরণে আইন-কানুন, বিধি-ব্যবস্থা চালু করেছিল। এর মাধ্যমে কামাল পাশা বৃটেনের মতো উন্নত হওয়ার স্বপ্ন দেখাতো। কিন্তু ফলাফল হলো, ১৯২৪ সালের পরের তুরস্ক ১৯২৪ সালের আগের তুরস্কের চেয়েও পিছিয়ে যায়। কারণ বৃটিশরা ওই সমস্ত আইন-কানুন, বিধি-ব্যবস্থা তাদের মতাদর্শ (Ideology) পুঁজিবাদের ভিত্তিতে গ্রহণ করেছিল। আর তুর্কিরা মতাদর্শ না বুঝে শুধু অন্ধ অনুকরণই করেছিল। অথচ ওই একই সময়ে মতাদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন লেলিন-স্ট্যালিনের হাত ধরে উন্নতির দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। কামাল পাশার মতো করে তৃতীয় বিশ্বের সবদেশের স্বাধীনতার স্থপতিরা পশ্চিমা দেশগুলোর আইন ও ব্যবস্থাকে অনুকরণ করতে গিয়ে কেবল ব্যর্থই হয়েছে।
সঠিক মতাদর্শিক চিন্তার ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে ও সেই চিন্তা থেকে উদ্ভূত আইন-কানুন ও বিধি-ব্যবস্থাকে জীবন ও রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে বাস্তবায়ন করে কীভাবে একটি জাতিকে উন্নত করা যায়, সেটার উজ্জ্বলতম উদাহরণ হলেন মহানবী মুহাম্মদ (সা)। আল্লাহ্র কাছ থেকে ওহী প্রপ্ত হওয়ার পর রাসুল (সা) আরবের মানুষকে ইসলামী বিশ্বাস তথা সঠিক মতাদর্শিক চিন্তার দিকে আহবান করেছিলেন। ৬২২ সালে তিনি মদীনার বিবাদমান দুই গোত্র আউস ও খাজরাযকে ইসলামী চিন্তার ভিত্তিতে একত্রিত করে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, সেটি পরবর্তী এক হাজার বছর ধরে বিশ্বকে সভ্যতা-উন্নতি-শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান সবকিছুর ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে খিলাফতে রাশেদা, উমাইয়া খিলাফত, আব্বাসীয় খিলাফত ও উসমানীয় খিলাফতের মহান খলীফাদের নেতৃত্বে ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্র ইসলামী মতাদর্শের ধারক-বাহক হিসেবে মাথা উঁচু করে বিশ্বে টিকে ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর ষড়যন্ত্র, মুস্তফা কামাল পাশাদের মতো বিশ্বাসঘাতকদের দালালি ও শেষদিককার খলীফাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে ইসলামী মতাদর্শ থেকে খিলাফত রাষ্ট্র ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হতে থাকে এবং ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ বিশ্বাসঘাতক মুস্তফা কামালের হাতে খিলাফত রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটে।
তাই পুনরায় জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদেরকে ইসলামী মতাদর্শের ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং সেই ঐক্যবদ্ধ জনগণের শক্তিতে ইসলামী আইন ও বিধি-ব্যবস্থা প্রয়োগকারী খিলাফত রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
টীকাঃ
১. মতাদর্শ (Ideology) হচ্ছে এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বাস যা থেকে একটি জীবন ব্যবস্থা বিকশিত হয়। যেমন পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও ইসলাম।
এর কারণ হলো প্রকৃতপক্ষে উন্নতি বলতে কেবল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে বোঝায় না। সঠিক উন্নতি বা পুনর্জাগরণ বলতে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আদর্শিক উন্নয়নকে বোঝায়। কোনো জাতি যখন মানুষ, জীবন ও মহাবিশ্ব সম্বন্ধে স্বচ্ছ চিন্তা ধারণ করে, এই জীবনের আগে কী ছিল ও এই জীবনের পরে কী হবে - এসব বিষয়ে সামগ্রিকভাবে সঠিক চিন্তার সন্ধান পায়, তখন সে জাতি অধঃপতিত অবস্থা থেকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি খুঁজে পায়। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দীন, আদর্শিকভাবে হীন একটি জাতির সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন কখনোই হয় না:
إِنَّ اللَّهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ
আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা তাদের নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করে। [সূরা রা’দ: ১১]
মানুষ, জীবন ও মহাবিশ্ব সম্বন্ধে সামগ্রিক ধারণা প্রদানকারী কোনো মতাদর্শ (Ideology) -কে আঁকড়ে না ধরলে কোনো জাতি প্রকৃত অর্থে উন্নত হতে পারবে না। তবে ভুল মতাদর্র্শ (Ideology) বেছে নিলে এই উন্নতি এক ধরনের ভুল উন্নতি হিসেবে চিহ্নিত হবে। যেমন: আমেরিকা, ইউরোপ বা চীনের মতো দেশগুলো অবশ্যই উন্নত, তবে এই উন্নতি হলো ভুল উন্নতি। কেননা এদের মতাদর্শ হলো পুঁজিবাদ (বা চীনের ক্ষেত্রে, পুঁজিবাদমিশ্রিত সমাজতন্ত্র)। ইউরোপ-আমেরিকা জাতি রাষ্ট্রসমূহ ওই পুঁজিবাদকে তাদের মানুষ, জীবন ও মহাবিশ্বসংক্রান্ত যাবতীয় চিন্তার ভিত্তি হিসেবে নিয়েছে, জীবন ও রাষ্ট্রের সকল সমস্যা সেই ঐক্যবদ্ধ চিন্তার ভিত্তিতে সমাধান করে। এরূপ মতাদর্শভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার কারণে একটি পর্যায় পর্যন্ত তারা সাফল্য পায় - যেমনটা তারা ইতিমধ্যে অর্জনও করেছে। কিন্তু মানবরচিত এসব মতাদর্শের ভ্রান্তির কারণে ওই উন্নতি আসলে সঠিক বা স্থায়ী উন্নতি নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯১৭ কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রভূত উন্নতি অর্জন করেছিল, কিন্তু মতাদর্শের দুর্বলতার কারণে তা ১৯৯১ সালে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। একইভাবে, বর্তমানে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার পতন-ধ্বনি শোনা যাচ্ছে -যেমনটা সোভিয়েত রাষ্ট্রে শোনা গিয়েছিল ১৯৮০-এর দশকে।
কারো কারো মনে অদ্ভুত ধারণা আছে যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতির কারণে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী আছে, মতাদর্শ হিসেবে পুঁজিবাদের বিকাশের আগে ইউরোপ-আমেরিকা ছিল অজ্ঞানতা ও পশ্চাৎপদতার অন্ধকার নিদর্শন। পুঁজিবাদী মতাদর্শের ভিত্তিতে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর ইউরোপ-আমেরিকার মতাদর্শিক রাষ্ট্রগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি করেছে। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি কোনো জাতির জেগে ওঠার মাধ্যম নয় -বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান হলো কোনো জাতির বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে জেগে ওঠার ফলাফল।
কেউ কেউ মনে করে, বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রগুলোর অনুকরণে আইন ও রাষ্ট্রকাঠামো সাজিয়ে নিলে ওই উন্নত রাষ্ট্রের সমকক্ষতা অর্জন করা যাবে তথা উন্নতি লাভ করা যাবে। কিন্তু অন্য দেশ থেকে আইন বা ব্যবস্থা আমদানি করে যে উন্নতি লাভ করা যায় না, বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের সবদেশই এর অনস্বীকার্য প্রমাণ। বাংলাদেশসহ এই দেশগুলো সংবিধান, রাষ্ট্রকাঠামো, আইন-কানুন, বিধি-ব্যবস্থা সবই ইউরোপ-আমেরিকা থেকে (স্বেচ্ছায় কিংবা চাপে পড়ে) নকল করেছে। এমন কি, এখনো এসব দেশের সরকারগুলো বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বা তথাকথিত দাতাদেশগুলো থেকে অহরহ নীতি, উপদেশ ধার করে যাচ্ছে। মুক্ত বাজার, গ্লোবালাইজেশন, গুড গভর্নেন্স -যখন যেটা পাচ্ছে চোখ বুঁজে নিয়ে নিচ্ছে। তবু উন্নতি অধরাই থেকে যায়।
এর কারণ হলো, ইউরোপ-আমেরিকার জাতি-রাষ্ট্রগুলো ওইসব আইন-কানুন, বিধি-ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তাদের নিজস্ব মতাদর্শিক চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাস থেকে। আর বাংলাদেশের মতো দেশগুলো মতাদর্শিক চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাসকে পাশ কাটিয়ে কেবল ভৃত্যের মতো আইন-কানুন ও বিধি-ব্যবস্থার মধ্যে উন্নতি খুঁজছে। মূলত কোনো আইন বা ব্যবস্থাকে যদি মতাদর্শের ভিত্তিতে নেয়া হয় তাহলে এক ধরনের ফলাফল হয়; আবার যদি মতাদর্শকে না বুঝে, বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতার মধ্যে থেকে ওই একই আইন বা ব্যবস্থাকে গ্রহণ করা হয়, তাহলে আরেক ধরনের ফলাফল হয়। ইতিহাস একথার স্বচ্ছ সাক্ষী। ১৯২৪ সাল থেকে মুস্তফা কামাল পাশা তুরস্কের সর্বত্র তৎকালীন বিশ্বের সুপারপাওয়ার বৃটেনের অনুকরণে আইন-কানুন, বিধি-ব্যবস্থা চালু করেছিল। এর মাধ্যমে কামাল পাশা বৃটেনের মতো উন্নত হওয়ার স্বপ্ন দেখাতো। কিন্তু ফলাফল হলো, ১৯২৪ সালের পরের তুরস্ক ১৯২৪ সালের আগের তুরস্কের চেয়েও পিছিয়ে যায়। কারণ বৃটিশরা ওই সমস্ত আইন-কানুন, বিধি-ব্যবস্থা তাদের মতাদর্শ (Ideology) পুঁজিবাদের ভিত্তিতে গ্রহণ করেছিল। আর তুর্কিরা মতাদর্শ না বুঝে শুধু অন্ধ অনুকরণই করেছিল। অথচ ওই একই সময়ে মতাদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন লেলিন-স্ট্যালিনের হাত ধরে উন্নতির দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। কামাল পাশার মতো করে তৃতীয় বিশ্বের সবদেশের স্বাধীনতার স্থপতিরা পশ্চিমা দেশগুলোর আইন ও ব্যবস্থাকে অনুকরণ করতে গিয়ে কেবল ব্যর্থই হয়েছে।
সঠিক মতাদর্শিক চিন্তার ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে ও সেই চিন্তা থেকে উদ্ভূত আইন-কানুন ও বিধি-ব্যবস্থাকে জীবন ও রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে বাস্তবায়ন করে কীভাবে একটি জাতিকে উন্নত করা যায়, সেটার উজ্জ্বলতম উদাহরণ হলেন মহানবী মুহাম্মদ (সা)। আল্লাহ্র কাছ থেকে ওহী প্রপ্ত হওয়ার পর রাসুল (সা) আরবের মানুষকে ইসলামী বিশ্বাস তথা সঠিক মতাদর্শিক চিন্তার দিকে আহবান করেছিলেন। ৬২২ সালে তিনি মদীনার বিবাদমান দুই গোত্র আউস ও খাজরাযকে ইসলামী চিন্তার ভিত্তিতে একত্রিত করে যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, সেটি পরবর্তী এক হাজার বছর ধরে বিশ্বকে সভ্যতা-উন্নতি-শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান সবকিছুর ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়। হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে খিলাফতে রাশেদা, উমাইয়া খিলাফত, আব্বাসীয় খিলাফত ও উসমানীয় খিলাফতের মহান খলীফাদের নেতৃত্বে ইসলামী খিলাফত রাষ্ট্র ইসলামী মতাদর্শের ধারক-বাহক হিসেবে মাথা উঁচু করে বিশ্বে টিকে ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর ষড়যন্ত্র, মুস্তফা কামাল পাশাদের মতো বিশ্বাসঘাতকদের দালালি ও শেষদিককার খলীফাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণে ইসলামী মতাদর্শ থেকে খিলাফত রাষ্ট্র ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হতে থাকে এবং ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ বিশ্বাসঘাতক মুস্তফা কামালের হাতে খিলাফত রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটে।
তাই পুনরায় জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে আমাদেরকে ইসলামী মতাদর্শের ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং সেই ঐক্যবদ্ধ জনগণের শক্তিতে ইসলামী আইন ও বিধি-ব্যবস্থা প্রয়োগকারী খিলাফত রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
টীকাঃ
১. মতাদর্শ (Ideology) হচ্ছে এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বাস যা থেকে একটি জীবন ব্যবস্থা বিকশিত হয়। যেমন পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও ইসলাম।