কেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে অসার ?
১৮০২ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন ডানবুরি ব্যাপিস্টদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের নীতি ব্যাখ্যা করে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটিকে ভিত্তি করে আমেরিকান সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করে প্রথম সংশোধন করা হয়। তিনি চিঠিতে লিখেন “ Believing with you that religion is a matter which lies solely between Man and his God, that he owes account to none other for his faith or his worship, that the legitimate powers of government reach actions only & not opinions, I contemplate with sovereign reverence that act of the whole American people which declared that their legislature should “makes no law respecting an establishment of religion, or prohibiting the free exercise thereof,” thus building a wall of separation between Church & State.” অর্থাৎ থমাস জেফারসনের কথায় রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের উপর কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করার বিষয়টি ফুটেছে। যা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের মুল কথা। থমাস জেফারসনের চিন্তাকে প্রতিষ্ঠার একই সূরে কথা বললেন তসলিমা নাসরীনও। গত ৫ ডিসেম্বর ০৭ বিবিসিকে তসলিমা নাসরীন বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার জন্যই আমি লিখি। বিতর্কিত তসলিমা নাসরীনের ন্যায় এ পথের কিছু অনুসারী, লক্ষ ও আদর্শচুত বাম রাজনীতিক সাম্রাজ্যবাদীদের উচ্ছিষ্টভোগী তথাকথিত কিছু বুদ্ধিজীবী সময়ে –আসময়ে দাবি তোলে আমাদের দেশের রাজনীতি থেকে ধর্মকে বাদ দেওয়ার। যে মতবাদের উদ্ভব হয়েছিল সপ্তদশকে অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপের বাস্তবতায়। খ্রিষ্টিয় চার্চের ধর্মের (যাজকদের বানান) নামে জনসাধারনের উপর অত্যাচার ও শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল (Reactionary) আন্দোলনের ভিত্তিতে উদ্ভব হয়েছিল যে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের। ইউরোপে ১৭৭৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ভিত্তিক জাতিরাষ্ট্রের(national state)। আর পশ্চিমাদের ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্রকে মডেল হিসাবে প্রতিষ্ঠার কৌশলের মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলেছে বিশ্বরাজনীতির ঘটনা প্রবাহ। তাই আমাদের দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক,সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে বারবার। বারংবার ব্যার্থতার পরেও যখন পুনরায় তা সাংবিধানিক ভাবে প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে একটি জনবিচ্ছিন্ন গোষ্টির কাছ থেকে, তখন বিশ্ব রাজনীতিতে মতবাদটির আবির্ভাবের বাস্তবতার নীরিখে এটির বুদ্ধিবৃত্তিক যৌক্তিকতা বিচার খুব প্রাসঙ্গিক। কারণ রাজনীতির ভিত্তি, আদর্শ ও দর্শণের মধ্যে যদি গলদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক অসারতা থাকে তাহলে সে রাজনীতি সাইত্রিশ বছর কেন সাতশ বছর চর্চা করলেও তা বিশ্ব মানবতাকে অধিকতর মঙ্গলজনক কিছু দিতে পারবে ন। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, যুদ্ধ ও অসুখকর সাংস্কৃতিক দুষণ দিয়ে বিশ্বকে বসবাসের ক্রমশ অনুপযোগী করে তুলেছে পশ্চিমের ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী রাজনীতি। নিচে আমরা এ মতাদর্শের আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট, কারণ ও ব্যার্থতা; বাস্তবতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির আলোকে যাচাই করার চেষ্টা করব।
বিচ্ছিন্নভাবে প্রাচীন গ্রীক ও অন্যান্য সময়ের কিছু চিন্তাবিদদের মাঝে রাষ্ট্র ব্যাবস্থায় ধর্মীয় সমাধানের বিরোধী মনোভাবের খোঁজ পাওয়া যায়। তবে ভাষায় বা সাহিত্যে সেকুলারিজম(secularism) বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কথাটি সর্বপ্রথম ১৮৪৬ সালে বৃটিশ লেখক জর্জ জ্যাকব হলিওয়েক ব্যাবহার করেন। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মতবাদ প্রধানত ইহজাগতিক কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কসমিন এ ব্যারি ও ইংলিশ সেকুলারিজমের থেকে পাওয়া সেকুলারিজমের সংজ্ঞা নিম্নরূপ-
১। একদিক থেকে বিবেচনা করলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলে এবং রাষ্ট্র নিজে ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে কোন প্রকার পক্ষপাত মূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে না। সরকারও জনগণের উপর চাপিয়ে দেবেনা। অন্য দিক থেকে এটি এমন একটি বিশ্বাসকে বোঝায় যে মানুষের যাবতীয় কার্যাবলি এবং সিদ্ধান্ত সমূহ(বিশেষ করে রাজনৈতিক) গ্রহণ করা হবে তথ্য ও বাস্তবতার ভিত্তিতে, কোন প্রকার ধর্মীয় বিবেচনায় নয়।
[Kosmin, Barry A “Contemporary Secularity and Secularism.”
Secularism & Secularity: Contemporary International Perspectives, Ed. Barry A. Kosmin and Artela Keysar. Hartford, CT: Institute for the study of Secularism in Society and Culture (ISSSC), 2007]
২। ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল মানুষের ইহলৌকিক দায়িত্ব সংক্রান্ত নিয়মাবলী এবং যারা ধর্মতত্ত্বকে অপূর্ণ, অস্পষ্ট, আস্থা স্থাপনের অযোগ্য এবং অবিশ্বাস্য মনে করে এই আদর্শ তাদের জন্য। এর মূল উপাদান তিনটিঃ ক) ইহলৌকিক জীবনের উন্নয়ন কেবল বস্তুর মাধ্যমেই হওয়া সম্ভব। খ) বিজ্ঞানই মানুষের জন্য একটি প্রাপ্তিসাধ্য ঈশ্বর। গ) যে কোনো ভালো কাজই ভালো। অন্য কোনো ভালো থাকুক বা না থাকুক বর্তমান জীবনের জন্য যা ভালো তার সন্ধানই শ্রেয়।(English Secularism,35)
`ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্ভবের প্রেক্ষাপট ও কারনঃ
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় মধ্যযুগব্যাপী ইউরোপের চার্চের কর্তৃপক্ষের অত্যাচার ও শোষনের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ফলেই এ মতবাদ বেড়ে উঠে। ঈসা(আঃ) এর উর্ধ্ব আরোহনের পর তার(আঃ) ধর্মের আসল বাণী বিকৃত করে মানবীয় চিন্তা-চেতনা, দর্শন ঢুকানো হয়। এমনকি কনসট্যানটাইন নামক এক রোমান সম্রাট খ্রিস্টবাদকে তার রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে ঘোষণা করে। তার তৈরি এই বিকৃত ধর্মের অনুসারী হতে সে জনসাধারণকে চাপ প্রয়োগ করে। সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদের ধারণা থেকে সরে আসা খ্রিস্টান ধর্ম যে মানুষের মনগড়া মতবাদ তার হাজার প্রমানের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ৩২৫ সালের নাইসিন সম্মেলন(Ncene Council)। এই সম্মেলেনে রোমান সম্রাজ্যের ১৮০০ বিশপ যোগ দেয়। যেখানে ইস্টার বানির (Ester Bunny) মতো রোমান সাংস্কৃতিক বিশ্বাসকে খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের মধ্যে ঢুকানো হয়। চারটি সংশোধিত বাইবেলকে তারা এ সম্মেলনে রাষ্ট্রীয় ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করে; এ ভার্সনে বিশ্বাসী খ্রিষ্টানরা এখনও সারা পৃথিবীতে রয়েছে।মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধ জ্ঞান বাইবেলে ঢুকানোর ফলে ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় বাইবেল সকল সমস্যার সমাধান দিতে ব্যার্থ হয়। এবং বাইবেলের মধ্যে প্রতিফলিত হয় মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা,অসম্পুর্ণতা,অসামঞ্জস্যতা ও স্ববিরোধীতা। এভাবে মানুষের বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান থেকে খ্রিস্টমতবাদ অনেক দূরে সরে যায়। মুলত; খ্রিষ্টীয় যাজক সম্প্রদায় ও চার্চের কর্তৃপক্ষ তাদের মনগড়া চিন্তা-ভাবনা খ্রিস্টবাদের নামে ধর্মীয় বাণী হিসেবে চালাতে থাকে।
মধ্যযুগব্যাপী জনসাধারণের উপর চার্চের এই প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব বজায় থাকে। এসময় ইউরোপের সম্রাট ও রাজারা চার্চের প্রতি মানুষের এ দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে নিজেদের মসনদকে আরো পাকা-পোক্ত রাখতে চার্চকে ব্যাবহার করে। এ এসময়ে ইউরোপে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিস্কার ও চিন্তা-ভাবনার প্রসার ঘটতে থাকে। যা খ্রিষ্টীয় যাজক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বাণীর সঙ্গে দন্দের সুত্রপাত ঘটায়। চার্চের প্রভাব হুমকির সম্মুখীন হতে থাকে। ফলে পোপ ও রাজারা বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবনকে অনুৎসাহিত করতে থাকে। এমনকি গ্যালিলিও ও কপারনিকাসের মত বিজ্ঞানীকে তারা শাস্তি ও প্রদান করে তদের আবিষ্কারের জন্য। এসব ঘটনা মানুষের কাছে খ্রিস্টবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও বাস্তব সমস্যা সমাধানের ব্যার্থতাকে পরিস্কার করে তোলে।
খ্রিষ্টীয় চার্চের ধর্মীয় যাজকদের শাসনে(Theocracy) সাধারন মানুষ ও চিন্তাবিদরা আতিষ্ট হয় বটে, কিন্তু ভুলে ভরা মানুষের তৈরি খ্রিস্টবাদের শোষণের তিক্ততায় তারা ভুল ক্রমে ধর্মের প্রতিই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে থাকে। এ সময়ে প্রধানত দুই শ্রেণীর চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের উদ্ভব ঘটে-
১। নাস্তিকতাবাদী ও
২। আপোষবাদী।
নাস্তিকতাবাদী দার্শনিকরা বাস্তব জীবন তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে সৃষ্টিকর্তা ও ধর্মকেই অস্বীকার করতে শুরু করে। এদের দু-একজন হলো- বস্তুবাদী হেগেল,মার্ক্স, লেলিন। এদের চিন্তার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে কমিউনিজম বা সোশালিজমের বিকাশ লাভ করে। আপোষবাদীরা ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করেনি। তদের আপোষটা ছিল – যদি কেউ ধর্মীয় বিশ্বাস লালন-পালন করতে চায়, তা একেবারে ব্যাক্তিগত জীবনে। চার্চের বা ধর্মের কোন প্রভাব রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকবে না। এ ঘরাণার চিন্তাবিদ বা দার্শনিকদের কয়েক জন হলেন- রুশো, ম্যাকিয়াভেলি, হবস, লক, ভলটেয়ার, মন্টেসকু প্রমুখ। আর এই আপোষবাদী (Compromise) চিন্তার ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে আজকের ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী সভ্যতা।
এ সকল দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের আবির্ভাব কালকে পশ্চিমারা আলোকিত যুগ(Enlightment) বলে আখ্যায়িত করে। এ সময়ে দীর্ঘকালব্যাপী খৃস্টান ধর্ম যাজক ও রাজারা বনাম দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের মধ্যে এক তুমুল সংগ্রাম ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। অবশেষে আপোষের মাধ্যমে চার্চের কর্তৃপক্ষরা ধর্মীয় বিধিবিধান প্রচার ও পালনকে শুধু মানুষের ব্যাক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ রাখতে সম্মত হয়।
এ প্রেক্ষাপটেই ম্যাকিয়াভেলি তার ‘দ্যা প্রিন্স’(The Prince) গ্রন্থে তার দেশের শাসককে ধর্মীয় রাষ্ট্রের পরিবর্তে জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “ভ্যাটিকান ইতালির মাঝখানে বসে চক্রান্তের জাল বুনে চলেছে। অতীতে সে রাজত্ব করছে। এখন তার দিন শেষ। ইতালির গৌরবের জন্য প্রয়োজন হলে ভ্যাটিকান কে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রাধীন আনতে হবে।” বস্তুতঃ শাসক গোষ্ঠির অত্যাচার ও নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তি পেতেই স্বাধীনতার (Freedom) শক্ত দাবি তুলেছিল ম্যাকিয়াভেলি, রুশোর ও লকের মত দার্শনিকরা। এ চিন্তাবিদরা ধর্মকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সময়ের অনুপযোগী হিসেবে দেখতে পেলেন। বিখ্যাত দার্শনিক হবস,লক,মন্টেস্কু,রুশো ব্যাক্তিকে এই কুসংস্কার ও পশ্চাদপদতার শৃঙ্খল থেকে বেড়িয়ে আসার আহ্বান জানায়। জেইন জ্যাকস রুশো (J.J. Rousseu) বলেন, “ মানুষ স্বাধীনভাবে জন্ম গ্রহণ করলেও তার পারিপার্শ্বিকতা তাকে শৃঙ্খলিত করে ফেলে(Man is born free but he is in chains everywhere.)। এই অভিব্যাক্তির মূল দাবি ছিল এমনই- নিজের ভাগ্য নিজের নির্ধারনের ক্ষমতা মানুষের হাতেই আছে। ভাগ্য ঈশ্বর কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত নয়। অর্থাৎ মানুষ জন্মগতভাবে উত্তম এবং স্বাধীন। ফলে রুশোও অবশেষে ফরাসী বিপ্লবের (French Revolution) পক্ষে কাজ করে। আর এই বিপ্লবের মাধ্যমেই চুড়ান্তভাবে রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা হয় এবং নিষ্পেষণকারী রাজা ও চার্চেরও পতন ঘটে। সৃষ্টি হয় সকল রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানের আইন ও নীতি তৈরিকারী সংসদীয় ব্যাবস্থা (Parliamentary System)। শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের পথ চলা।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ব্যার্থতাঃ
একটি আদর্শ ও মতবাদের সঠিকতা বিচার করতে চাইলে, আমাদেরকে দেখতে হবে এটা কোনো বাস্তবিক ভিত্তির (Rationality) উপর প্রতিষ্ঠিত কি-না। মহাজগৎ সৃষ্টি, মানুষ, এ জীবনের আগে ও পরে কী আছে; মানব জীবনের এ সকল মূল প্রশ্নের কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক সুস্পষ্ট উত্তর সেই মতবাদটি দেয় কি-না তার উপরও। কারণ প্রত্যেকটি সুস্থ্য-স্বাভাবিক মানুষের চিন্তায় এসকল মূল প্রশ্ন শৈশব থেকেই ঘোরা-ফেরা করে। এগুলোর বাস্তব সম্মত কোন উত্তর না পেলে সে সন্তুষ্ট হতে পারে না। এই চিন্তাগুলোর উত্তরের উপরই নির্ভর করে প্রতিটি মানুষের জীবন পদ্ধতি (Life Style)। । যেমন; একজন নাস্তিকের জীবন পদ্ধতি এক রকম পক্ষান্তরে আস্তিকের জীবন পদ্ধতি আরেক রকমের। মতবাদের সঠিকতার আরেকটি নির্ণায়ক হলো এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির সাথে মানানসই কি-না।
এবার আমরা একটু উপরিউল্লিখিত নির্ণায়ক গুলোর আলোকে ও আমাদের সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের পক্ষে যে সকল যুক্তি বিদ্যমান সেগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি ও বাস্তবায়নের ফলাফলগুলো পর্যালোচনা করবো।
১। পশ্চিমের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা প্রায়ই বলে থাকে, “keep your religion to yourself, don’t bring it into politics” একই সুর ধরে আমাদের দেশের কেউ কেউ বলে, “ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার” কিন্তু এই ধারণাটা যৌক্তিক কিনা তা সমাজের সর্বোচ্চ সংগঠনটির(রাষ্ট্র) দিকে তাকালে দেখতে পাই। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ধর্ম ও ধর্ম প্রচারক এসেছে সকলেই সমাজ সংস্কারের কাজ করেছেন। কিন্তু রাজনীতি ছাড়া সমাজের পরিবর্তন কখনো সম্ভব নয়। সকল ধর্ম প্রচারকরাই রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার নীতি গুলোকে পরিবর্তিত ও প্রভাবিত করেছিলেন এবং বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই বলা যায় সমাজে মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াই এক ধরনের রাজনৈতিক প্রচেষ্টা। যে সমাজে ধর্ম বিদ্যমান সেখানে ধর্মের চিরায়ত প্রবনতা হলো সমাজ সংস্কার করা। অর্থাৎ ধর্মের প্রবনতা থেকেই ধর্ম ও রাজনীতির সুগভীর সম্পর্ক প্রতিয়মান। উদাহরন হিসেবে বলা যায় আরবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবার পর সেখানকার সমাজ ব্যাবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তিত হয়ে যায়।
২। “কেউ যেন তার ধর্মীয় বিশ্বাস কে অন্যের উপর না চাপিয়ে দিতে পারে তাই ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখা উচিৎ।” এ যুক্তিটি ও একটি খোড়া যুক্তি কারন সমাজে বসোবাসকারী এক জনের চিন্তা দ্বারা সব সময়ই অন্যে প্রভাবিত হয়। চিন্তার চরিত্রটাই এমন যে তা পূর্ববর্তী কোনো চিন্তার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে। এছাড়া সমাজ বা রাষ্ট্রে ধর্মের প্রভাব থাকবে না, এটাকেও আমরা একটা নতুন এক ধর্মীয় মতাদর্শ বলতে পারি। যে ধর্মের নাম ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সৃষ্টিকর্তা ও ধর্ম সম্পর্কে নতুন চিন্তা সহকারে এক নতুন মতাদর্শ সমাজে নিয়ে এসেছে। যা অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন কোন কর্তৃপক্ষ যদি বলে ‘এখানে কোন আইন থাকবে না’। এটাও একটা নতুন আইন সৃষ্টি করে। স্বরুপ ইসলাম রাষ্ট্রে সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির অনুমোদন দেয় না। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ পুজিবাদী রাষ্ট্রে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া আইন মান্য করা বা ধর্ম পালন করা সম্ভব নয়। বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদই অন্য ধর্মের স্বাধীনতা দেয় না।
৩। কেউ কেউ বলে “ এই আধুনিক যুগে সৃষ্টিকর্তার আইন বা ধর্মীয় আইন অচল। ধর্মীয় আইন এখন সেকেলে”। কিন্তু বাস্তবতা হলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি(instinct) সব সময় স্থির ও অপরিবর্তনশীল। সব কালেই মানুষের শারীরিক ও মানসিক ক্ষুধা ছিল, আছে ও থাকবে। তাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি অপরিবর্তনশীল হওয়ায় অতীতে যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ও মনুষ্য সমাজের জন্য ক্ষতিকর ছিল ভবিষ্যতেও তা একই রকম থাকবে। অতীতেও নারী-পুরুষের মধ্যে জৈবিক ক্ষুধা, সন্তান উৎপাদন ও সম্পদের মালিকানার আকাঙ্ক্ষা, আধ্যাত্মিক ক্ষুধা(Spritual instict)/বড় শক্তির আনুগত্য করা/সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করার বিষয়গুলো বিদ্যমান ছিল, বর্তমানেও আছে ভবিষ্যতেও থাকবে। আর এ সকল চাহিদাগুলো সুষ্ঠুভাবে পূরণের মধ্যেই সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিদ্যমান। তাই এ চাহিদাগুলো পূরণের জন্য একটি সার্বজনীন সর্বযুগ উপযোগী নীতি ও আইন থাকাটাই ব্যাঞ্জনীয় ও যৌক্তিক। যেহেতু সৃষ্টিকর্তা মানুষের এসকল প্রবৃত্তির স্রষ্টা, তাই সব যুগের উপযোগী,সব জাতি, বর্ণের মানুষের সবচেয়ে সুন্দর ভাবে এগুলো পূরণ করার বিধান তিনিই(আল্লাহতায়ালা) শুধু ঠিক ভাবে দিতে সক্ষম। সুতরাং সৃষ্টিকর্তার আইনের ক্ষেত্রে একাল-সেকাল বা আধুনিক-অনাধুনিক বলা অযৌক্তিক। তাছাড়া আমাদের সুখ-দুঃখের অনুভুতি, হাসি-কান্না, ছোটদের স্নেহকরা, সত্যবাদীকে পছন্দ করার মত বিষয়গুলো তো সৃষ্টির শুরু থেকেই চলে আসছে। পুরাতন বলে কি এগুলো আমরা পরিহার করি? অথবা নতুন রোগ বলে কেউ কি এইডসকে স্বাগতম জানায়? তাই পুরাতন কোন কিছু বর্তমান যুগের জন্য ভাল নয় এবং নতুন বলে কোন কিছু ভালো হবে এরও কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই।
এবার আসা যাক আরো কিছু বাস্তবিক যুক্তির আলোচনায়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উদ্ভব হয়েছিল চার্চের শোষণ নির্যাতনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার(Negative Reaction) ফল স্বরুপ। কিন্তু কোনো ঠিক বা শুদ্ধ মতবাদ কখনো পরিবেশের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নিতে পারে না। কারন ঐ পরিবেশ-পরিস্থিতি যদি সরিয়ে ফেলা হয় বা ভিন্ন রকম হয় তাহলে ঐ মতবাদের সমস্ত ধারনা(Concept) অগ্রহনযোগ্য বা বাতিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ ধরা যাক চার্চের শাসনে যদি ইউরোপে শান্তি বিরাজ করতো তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা সেখানকার মানুষের কাছে থাকত সম্পূর্ণ অগ্রহনযোগ্য। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কোন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠেনি।
সর্বজন স্বীকৃত ও প্রমানিত ঈসা(আঃ) এর উর্ধ্ব আরোহণের পর ঈঞ্জিলের বার বার সংস্করণ করা হয়। ফলে এর মধ্যে খ্রিস্টান যাজকেরা তাদের মনগড়া মতবাদ, চিন্তা-ভাবনা ঢুকিয়ে এর মৌলিকত্ব নষ্ট করে ফেলে। ফলে এটি হয়ে ওঠে আরেকটি মানুষের তৈরি রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালনার দলিল। তাই ধর্মনিরপেক্ষবাদী বিপ্লবের পর আরেকটি মানুষের তৈরি ব্যাবস্থাই গ্রহন করা হয়। নতুন উৎসও সেই মানব সৃষ্ট মতবাদ। যার মধ্যে ভুল ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ইউরোপে মূলতঃ কোন পরিবর্তন আসেনি। কারণ একটি মানুষের তৈরি ব্যাবস্থা পরিবর্তিত হয়ে আর একটি মানুষের তৈরি ব্যাবস্থা এসেছে। এছাড়া খ্রিষ্টান ধর্মের অভিজ্ঞতা দিয়ে সব ধর্মকে বিচার করা যৌক্তিক নয়। এবং বাকি সব ধর্মে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বাণী বিকৃত হয়েছে এ ধারণাও ঠিক নয়। কারণ ইসলাম ধর্মের কুরআনই তার বাস্তব প্রমাণ। কুরআনের আদর্শ বাস্তবায়নের ফলে ইউরোপের মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন আরব ঐ সমকালীন সময়েই ১৪০০ বছরের এক স্বর্ণালী সভ্যতার নিদর্শন হয়ে আছে। খিলাফতের শাসনামলে এ রাষ্ট্র জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক উতকর্ষতার অনবদ্য এক উদাহরণ। কিন্তু আজকের মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায় কুরাআন-সুন্নাহর আদর্শ ভিত্তিক সেই রাষ্ট্র ব্যাবস্থার অনুপস্থিতিতে পর্যাপ্ত সম্পদ হাতে থাকা সত্ত্বেও মুসলিমরা আজ দরিদ্র পীড়িত, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-অর্থনীতির দিক থেকে পিছিয়ে পরা এক জাতি। তাই আবারো সারা বিশ্বের মুসলিমরা ইসলামী আদর্শিক রাষ্ট্র ব্যাবস্থা ফিরিয়ে আনতে সোচ্চার।
আমেরিকা বা ব্রিটেনে প্রথম সংবিধান প্রনয়ণ ও গ্রহণকালে সেখানকার সমাজে সমকামিতা প্রচন্ডভাবে ঘৃনা করা হতো, আর পর্ণগ্রাফির কথা তো কল্পনাই করা যেত না। কিন্তু সে সময়ের সংবিধান প্রনেতারা যদি আজকে দেখতেন, তাদের সংবিধান অনুসরণ করে সমকামীরাই আজ সহজে পার্লামেন্ট সদস্য হচ্ছে। পর্ণগ্রাফি বিস্তরভাবে ছড়ানো হচ্ছে সমাজে। এবং ব্রিটেনে দশ লক্ষেরও বেশি নাগরিক বিভিন্ন অপরাধে জেলের মধ্যে রয়েছে। এসব অনুধাবন করার ক্ষমতা তাদের থাকলে তারা এ সংবিধান ভিন্নভাবেই লিখতেন। অর্থাৎ এ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় মানুষের সীমিত জ্ঞানের পরিধি দিয়ে এবং ভবিষ্যৎ বাস্তবতা বিশদ ও ঠিক ভাবে বুঝতে পারার অক্ষমতার কারণে মানুষের তৈরী জীবন বিধান দিয়ে সমাজ কখনো সর্বযুগোপযোগী ব্যাবস্থা সহকারে শান্তিপূর্ণভাবে চলতে পারে না।
ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষের সহজাত প্রকৃতি বা স্বভাব বুঝতেও ব্যার্থ হয়েছে। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায় পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন মানুষ বড় কোন শক্তি বা তার চেয়ে চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে অধিকতর শ্রেষ্ঠ মনে করে তার আনুগত্য প্রকাশ করতে চায় যেমন- কেউ সূর্য, চন্দ্র, বৃহৎ গাছ, আগুন। আবার কেউ কেউ তার চেয়ে উন্নত কোন মানুষের চিন্তার পুজারী যেমন মার্কস ও লেলিনবাদীরা। কিন্তু সমস্যাটি ঘটে তখন, যখন বস্তু ও মহাজগতের প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার উপাসনা না করে মানুষ কোন সৃষ্টি বস্তুর আনুগত্য করে। সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করার তার সহজাত প্রবৃত্তিকে ভুলভাবে নিবৃত করতে চায়। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মানুষের কাছে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও তার উপাসনা করা বা না-করার ব্যাপারে কোন ঠিক ও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। পশ্চিমের মানুষের আধ্যাত্মিক চিন্তার খোরাক যোগাতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ। তাই দেখা যায় অনেক অর্থ-বিত্তের মাঝেও বিষণ্নতা ও মানসিক রোগ পশ্চিমে মহামারি আকার ধারন করছে। সর্বোপরি সবচেয়ে বড় শক্তিধর সৃষ্টিকর্তার উপর মানুষের যে নির্ভরতা বা তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার মানুষের যে সহজাত আকাঙ্ক্ষা তা মূলতঃ সৃষ্টিকর্তার হুকুম বা সামগ্রীক জীবন বিধান মান্য করারই নির্ভরতা বা মনস্ত্বাত্ত্বিক ক্ষুধা। তাই মানুষ সহজাতভাবেই সৃষ্টিকর্তার জীবন ব্যাবস্থা ব্যাক্তিগত জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ও মানতে চায়। এবং তা মান্য করেই প্রশান্তি লাভ করতে পারে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মানুষের জীবনের এই সকল মৌলিক চাহিদার যোগান দিতে সম্পূর্ণরুপে ব্যার্থ হয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বিপ্লবে সৃষ্টিকর্তার ধর্মকে অস্বীকারকারী গোষ্টির সঙ্গে ধর্মকে বা সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাসকারী চিন্তাবিদদের যে কম্প্রমাইজ বা আপোষ হয়েছিল সেটিও ছিল ভিত্তিহীন ও অযৌক্তি। কেননা দুটি সাংঘর্ষিক বা বিপরীতমূখী বিষয়ের মধ্যে কখনো আপোষ হওয়া অসম্ভব। উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন এক দল লোক বলল, ঢাকা নামে একটি শহর আছে। আরেক দল লোক বলল, ঢাকা নামে কোন শহর নাই। তখন তাদের মধ্যে কম্প্রমাইজ হয়ে এর মাঝামাঝি কোন মতে পৌছান হয়, তাহলে সে সমাধান হবে সত্য বিবর্জিত। তাই সৃষ্টিকর্তা আছে, না সৃষ্টিকর্তা নেই এ দুটির মাঝে কম্প্রমাইজও কোন ঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। কারণ এ দুটোর যে কোন একটি বাস্তবতা সত্য ধারণ করে। তাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মহাজগতের সাথে সম্পৃক্ত, মানুষ ও সমাজের সাথে সম্পৃক্ত এই সত্যকে বা এই বিষয়টিকে যখন মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও রাষ্ট্র থেকে আলাদা রাখতে চায় অযৌক্তিকভাবে। সৃষ্টিকর্তা কি শুধু মানুষের ব্যাক্তিগত জীবনের সমস্যা সমাধান দিতে পারেন, তিনি কি সমষ্টিগত জীবনের সমাধান দিতে পারেন না? প্রত্যেকটি মানুষকে সৃষ্টিকর্তার বিষয়ক এ মৌলিক প্রশ্নের ঠিক উত্তর না দিলে, তা মানুষের জীবনে ও সমাজে অসঙ্গতি, অসামঞ্জস্যতা, স্ব-বিরোধীতা ও অনিয়ম ছাড়া কিছুই দিতে পারেনা। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা মানুষ এবং সমাজের ব্যাপারে কোনটি ভালো কোনটি খারাপ চুড়ান্তভাবে বলতে পারেনা। সুখ, প্রশান্তি ও তৃপ্তির ধারণায় থাকেনা কোন ঐক্য। ফলে সৃষ্টি হয় দিধা-দ্বন্দ্ব(confusion) ও অসামঞ্জস্যতা (contradiction)। সত্য ও মিথ্যার কম্প্রমাইজ তাদের জীবনে নিয়ে আসে চুড়ান্ত বিভ্রান্তি। এর প্রতিফলন আমরা ধর্মনিরপেক্ষ জাতিগুলোর নীতি প্রণয়ন ও জীবন পদ্ধতি (life style) এর মধ্যেও স্পষ্ট দেখতে পাই। পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই মানুষের স্বভাবের সঙ্গে মানানসই ব্যাক্তিগত জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সৃষ্টিকর্তার আদেশ নিষেধ মেনে জীবন যাপনের ব্যাবস্থা (System) শুধু ইসলামই দেয়। এখানে ভালো-মন্দ শরিয়া আইনের মাধ্যমে স্থায়ী ভাবে নির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট এবং যা বাস্তবায়ন যোগ্য। এর প্রমাণ হলো ইসলামী খিলাফতের ১৪০০ বছরের ইতিহাস।
রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার পরই সেখানে বিপ্লব (Industrial Revolution) ঘটার পর অর্থনৈতিক ও টেকনোলজির উন্নয়ন ঘটেছে। এই উদাহরন পশ্চিমারা অনেক মুসলিমকে বোঝানোর চেষ্টা করছে এখনো। কেউ কেউ ভুল করে এ মতবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু আসল কথা হলো যে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার স্লোগান নিয়ে যে উন্নয়নের কথা তারা বলেছিল তার বাস্তবায়ন কি আজও ঘটেছে? যতটুকু ঘটেছে সে বস্তুবাদী উন্নয়ন তাদের আজ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে? ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধারণ করার পর যে পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী জীবন যাপনের দিকে তারা ধাবিত হয়েছে সে কারণে সারা বিশ্ব থেকে অন্যান্য জাতির সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়ার কৌশল তারা অবলম্বন করেছে। সৃষ্ট হয়েছে উপনিবেশবাদ, নব্য উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের। অন্যান্য জাতিগুলোকে অসাম্য ও পরাধীনতার মধ্যে ঠেলে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা কি নিজেদের সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে? পৃথিবীর অধিকাংশ পুঁজির মালিক এখন গুটি কয়েক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী। সম্পদশালী পুজীর মালিকরাই তাদের স্বার্থরক্ষাকারীদের তাদের শাসন ক্ষমতায় বসায়। চার্চের শাসনামলের মতো ইউরোপের মানুষ এখনো প্রচন্ড রক্ষণশীল। অভিজাত শ্রেণীর সামাজিক কাঠামোর (Aristocratic Social Class Structure) কারণে এখনো এ অভিজাত শ্রেণীর মানুষেরা জনগণের কোন ম্যানডেট ছাড়াই বৃটেনের লর্ডসভার সদস্য পদ লাভ করে। শ্রমিক শ্রেণীর মানুষেরা এখনো প্রচন্ড ভোগান্তি ও বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষবাদী এই বিপ্লব সংখ্যা গরিষ্ট মনুষের এই দুর্ভোগ কোন উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে পারেনি। এখনো সংখ্যা গরিষ্ট মানুষ অর্থনৈতিক দাসত্বের মধ্যেই রয়েছে। এর উদাহরন হলো- ২০০৭ সালে ও আমেরিকাতে আড়াই(2.5) কোটি ভাসমান মানুষ বসবাস করে।
অপর পক্ষে পশ্চিমের মানুষের সামগ্রীক জীবনের চিন্তা চেতনা ও সংস্কৃতিক কাঠামো আজ সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে জর্জরিত। ধর্মনিরপেক্ষবাদ তাদের সমাজে সীমাহীন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। শুধু বস্তুর মাঝে সুখ তথা ভোগের মাঝে সুখ এই মিথ্যা ধারণা, হতাশা ও বিভ্রান্তি ছাড়া কিছু দেয়নি। তাই আমরা যখন দেখি পৃথিবির ৪% এর ও কম আমেরিকায় বাস করে কিন্তু তারা পৃথিবীর ৩৫% এর ও বেশী সম্পদ ভোগ কর। এমনকি আমেরিকার মধ্যেও সেখানকার ১০% মানুষ সে দেশের ৯০% এরও বেশি সম্পদের মালিক। এবং সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। আর সে দেশেরই পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠি শুধু সম্পদ লুটের নেশায় পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের প্রতি বৃদ্ধা আঙ্গুলি উচিয়ে গুচ্ছ বোমার আঘাতে হত্যা করে আফগানিস্তান ও ইরাকের লক্ষ লক্ষ আবাল বৃদ্ধ-বনিতাকে। এ দৃশ্য দেখে সচেতন মানুষেরা সত্যিই বিষ্ময়াভিভূত হয় না। দুঃখ ও শোকে এ ভ্রান্ত চিন্তা বহনকারীদের নিবারণের জন্য ফেটে পড়ে রাজপথে। যখন দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে তরুণ রবার্ট হক্সিন্স বিখ্যাত হবার আশায় ৮ জনকে গুলি করে আত্ম-হত্যা করে, তখন সুস্পষ্ট জীবন ব্যাবস্থা পাওয়া জনগোষ্টি মোটেই অবাক হয়না। যখন দেখা যায় ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলে তারা মুখে ফেনা তুলে ফেলে অথচ ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের সুতিকাগার রাষ্ট্রে (ফ্রান্স) ‘হিজাব’ নিষিদ্ধ করা হয় আইন করে; তখনও মোটেও আশ্চার্যান্বিত হওয়ার কিছু থাকেনা। যখন দেখা যায় ইউরোপ আমেরিকার নারীরা নিজের বাচ্চা ও স্বামীর চেয়ে পোষা কুকুরের প্রতি যত্নশীল তখন হতবাক হবার কিছুই নেই। কারন বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ভিত্তিহীন ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী অযৌক্তিক চিন্তাই তাদের চিন্তা-ভাবনা ও জীবন পরিচালনার ভিত্তি। এই ভুল মতবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা চিন্তা, ধারণা ও জীবন দর্শনই আজ তাদের পতনের শেষ প্রান্তে নিয়ে এসেছে।
বিচ্ছিন্নভাবে প্রাচীন গ্রীক ও অন্যান্য সময়ের কিছু চিন্তাবিদদের মাঝে রাষ্ট্র ব্যাবস্থায় ধর্মীয় সমাধানের বিরোধী মনোভাবের খোঁজ পাওয়া যায়। তবে ভাষায় বা সাহিত্যে সেকুলারিজম(secularism) বা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কথাটি সর্বপ্রথম ১৮৪৬ সালে বৃটিশ লেখক জর্জ জ্যাকব হলিওয়েক ব্যাবহার করেন। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মতবাদ প্রধানত ইহজাগতিক কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কসমিন এ ব্যারি ও ইংলিশ সেকুলারিজমের থেকে পাওয়া সেকুলারিজমের সংজ্ঞা নিম্নরূপ-
১। একদিক থেকে বিবেচনা করলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলে এবং রাষ্ট্র নিজে ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে কোন প্রকার পক্ষপাত মূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে না। সরকারও জনগণের উপর চাপিয়ে দেবেনা। অন্য দিক থেকে এটি এমন একটি বিশ্বাসকে বোঝায় যে মানুষের যাবতীয় কার্যাবলি এবং সিদ্ধান্ত সমূহ(বিশেষ করে রাজনৈতিক) গ্রহণ করা হবে তথ্য ও বাস্তবতার ভিত্তিতে, কোন প্রকার ধর্মীয় বিবেচনায় নয়।
[Kosmin, Barry A “Contemporary Secularity and Secularism.”
Secularism & Secularity: Contemporary International Perspectives, Ed. Barry A. Kosmin and Artela Keysar. Hartford, CT: Institute for the study of Secularism in Society and Culture (ISSSC), 2007]
২। ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল মানুষের ইহলৌকিক দায়িত্ব সংক্রান্ত নিয়মাবলী এবং যারা ধর্মতত্ত্বকে অপূর্ণ, অস্পষ্ট, আস্থা স্থাপনের অযোগ্য এবং অবিশ্বাস্য মনে করে এই আদর্শ তাদের জন্য। এর মূল উপাদান তিনটিঃ ক) ইহলৌকিক জীবনের উন্নয়ন কেবল বস্তুর মাধ্যমেই হওয়া সম্ভব। খ) বিজ্ঞানই মানুষের জন্য একটি প্রাপ্তিসাধ্য ঈশ্বর। গ) যে কোনো ভালো কাজই ভালো। অন্য কোনো ভালো থাকুক বা না থাকুক বর্তমান জীবনের জন্য যা ভালো তার সন্ধানই শ্রেয়।(English Secularism,35)
`ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্ভবের প্রেক্ষাপট ও কারনঃ
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায় মধ্যযুগব্যাপী ইউরোপের চার্চের কর্তৃপক্ষের অত্যাচার ও শোষনের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ফলেই এ মতবাদ বেড়ে উঠে। ঈসা(আঃ) এর উর্ধ্ব আরোহনের পর তার(আঃ) ধর্মের আসল বাণী বিকৃত করে মানবীয় চিন্তা-চেতনা, দর্শন ঢুকানো হয়। এমনকি কনসট্যানটাইন নামক এক রোমান সম্রাট খ্রিস্টবাদকে তার রাষ্ট্র ধর্ম হিসাবে ঘোষণা করে। তার তৈরি এই বিকৃত ধর্মের অনুসারী হতে সে জনসাধারণকে চাপ প্রয়োগ করে। সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদের ধারণা থেকে সরে আসা খ্রিস্টান ধর্ম যে মানুষের মনগড়া মতবাদ তার হাজার প্রমানের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ৩২৫ সালের নাইসিন সম্মেলন(Ncene Council)। এই সম্মেলেনে রোমান সম্রাজ্যের ১৮০০ বিশপ যোগ দেয়। যেখানে ইস্টার বানির (Ester Bunny) মতো রোমান সাংস্কৃতিক বিশ্বাসকে খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসের মধ্যে ঢুকানো হয়। চারটি সংশোধিত বাইবেলকে তারা এ সম্মেলনে রাষ্ট্রীয় ধর্মগ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করে; এ ভার্সনে বিশ্বাসী খ্রিষ্টানরা এখনও সারা পৃথিবীতে রয়েছে।মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধ জ্ঞান বাইবেলে ঢুকানোর ফলে ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় বাইবেল সকল সমস্যার সমাধান দিতে ব্যার্থ হয়। এবং বাইবেলের মধ্যে প্রতিফলিত হয় মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা,অসম্পুর্ণতা,অসামঞ্জস্যতা ও স্ববিরোধীতা। এভাবে মানুষের বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান থেকে খ্রিস্টমতবাদ অনেক দূরে সরে যায়। মুলত; খ্রিষ্টীয় যাজক সম্প্রদায় ও চার্চের কর্তৃপক্ষ তাদের মনগড়া চিন্তা-ভাবনা খ্রিস্টবাদের নামে ধর্মীয় বাণী হিসেবে চালাতে থাকে।
মধ্যযুগব্যাপী জনসাধারণের উপর চার্চের এই প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব বজায় থাকে। এসময় ইউরোপের সম্রাট ও রাজারা চার্চের প্রতি মানুষের এ দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে নিজেদের মসনদকে আরো পাকা-পোক্ত রাখতে চার্চকে ব্যাবহার করে। এ এসময়ে ইউরোপে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিস্কার ও চিন্তা-ভাবনার প্রসার ঘটতে থাকে। যা খ্রিষ্টীয় যাজক সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বাণীর সঙ্গে দন্দের সুত্রপাত ঘটায়। চার্চের প্রভাব হুমকির সম্মুখীন হতে থাকে। ফলে পোপ ও রাজারা বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবনকে অনুৎসাহিত করতে থাকে। এমনকি গ্যালিলিও ও কপারনিকাসের মত বিজ্ঞানীকে তারা শাস্তি ও প্রদান করে তদের আবিষ্কারের জন্য। এসব ঘটনা মানুষের কাছে খ্রিস্টবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও বাস্তব সমস্যা সমাধানের ব্যার্থতাকে পরিস্কার করে তোলে।
খ্রিষ্টীয় চার্চের ধর্মীয় যাজকদের শাসনে(Theocracy) সাধারন মানুষ ও চিন্তাবিদরা আতিষ্ট হয় বটে, কিন্তু ভুলে ভরা মানুষের তৈরি খ্রিস্টবাদের শোষণের তিক্ততায় তারা ভুল ক্রমে ধর্মের প্রতিই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে থাকে। এ সময়ে প্রধানত দুই শ্রেণীর চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের উদ্ভব ঘটে-
১। নাস্তিকতাবাদী ও
২। আপোষবাদী।
নাস্তিকতাবাদী দার্শনিকরা বাস্তব জীবন তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে সৃষ্টিকর্তা ও ধর্মকেই অস্বীকার করতে শুরু করে। এদের দু-একজন হলো- বস্তুবাদী হেগেল,মার্ক্স, লেলিন। এদের চিন্তার উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে কমিউনিজম বা সোশালিজমের বিকাশ লাভ করে। আপোষবাদীরা ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তাকে অস্বীকার করেনি। তদের আপোষটা ছিল – যদি কেউ ধর্মীয় বিশ্বাস লালন-পালন করতে চায়, তা একেবারে ব্যাক্তিগত জীবনে। চার্চের বা ধর্মের কোন প্রভাব রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকবে না। এ ঘরাণার চিন্তাবিদ বা দার্শনিকদের কয়েক জন হলেন- রুশো, ম্যাকিয়াভেলি, হবস, লক, ভলটেয়ার, মন্টেসকু প্রমুখ। আর এই আপোষবাদী (Compromise) চিন্তার ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে আজকের ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী সভ্যতা।
এ সকল দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের আবির্ভাব কালকে পশ্চিমারা আলোকিত যুগ(Enlightment) বলে আখ্যায়িত করে। এ সময়ে দীর্ঘকালব্যাপী খৃস্টান ধর্ম যাজক ও রাজারা বনাম দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের মধ্যে এক তুমুল সংগ্রাম ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। অবশেষে আপোষের মাধ্যমে চার্চের কর্তৃপক্ষরা ধর্মীয় বিধিবিধান প্রচার ও পালনকে শুধু মানুষের ব্যাক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ রাখতে সম্মত হয়।
এ প্রেক্ষাপটেই ম্যাকিয়াভেলি তার ‘দ্যা প্রিন্স’(The Prince) গ্রন্থে তার দেশের শাসককে ধর্মীয় রাষ্ট্রের পরিবর্তে জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “ভ্যাটিকান ইতালির মাঝখানে বসে চক্রান্তের জাল বুনে চলেছে। অতীতে সে রাজত্ব করছে। এখন তার দিন শেষ। ইতালির গৌরবের জন্য প্রয়োজন হলে ভ্যাটিকান কে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রাধীন আনতে হবে।” বস্তুতঃ শাসক গোষ্ঠির অত্যাচার ও নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তি পেতেই স্বাধীনতার (Freedom) শক্ত দাবি তুলেছিল ম্যাকিয়াভেলি, রুশোর ও লকের মত দার্শনিকরা। এ চিন্তাবিদরা ধর্মকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সময়ের অনুপযোগী হিসেবে দেখতে পেলেন। বিখ্যাত দার্শনিক হবস,লক,মন্টেস্কু,রুশো ব্যাক্তিকে এই কুসংস্কার ও পশ্চাদপদতার শৃঙ্খল থেকে বেড়িয়ে আসার আহ্বান জানায়। জেইন জ্যাকস রুশো (J.J. Rousseu) বলেন, “ মানুষ স্বাধীনভাবে জন্ম গ্রহণ করলেও তার পারিপার্শ্বিকতা তাকে শৃঙ্খলিত করে ফেলে(Man is born free but he is in chains everywhere.)। এই অভিব্যাক্তির মূল দাবি ছিল এমনই- নিজের ভাগ্য নিজের নির্ধারনের ক্ষমতা মানুষের হাতেই আছে। ভাগ্য ঈশ্বর কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত নয়। অর্থাৎ মানুষ জন্মগতভাবে উত্তম এবং স্বাধীন। ফলে রুশোও অবশেষে ফরাসী বিপ্লবের (French Revolution) পক্ষে কাজ করে। আর এই বিপ্লবের মাধ্যমেই চুড়ান্তভাবে রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা হয় এবং নিষ্পেষণকারী রাজা ও চার্চেরও পতন ঘটে। সৃষ্টি হয় সকল রাষ্ট্রীয় সমস্যা সমাধানের আইন ও নীতি তৈরিকারী সংসদীয় ব্যাবস্থা (Parliamentary System)। শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের পথ চলা।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ব্যার্থতাঃ
একটি আদর্শ ও মতবাদের সঠিকতা বিচার করতে চাইলে, আমাদেরকে দেখতে হবে এটা কোনো বাস্তবিক ভিত্তির (Rationality) উপর প্রতিষ্ঠিত কি-না। মহাজগৎ সৃষ্টি, মানুষ, এ জীবনের আগে ও পরে কী আছে; মানব জীবনের এ সকল মূল প্রশ্নের কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক সুস্পষ্ট উত্তর সেই মতবাদটি দেয় কি-না তার উপরও। কারণ প্রত্যেকটি সুস্থ্য-স্বাভাবিক মানুষের চিন্তায় এসকল মূল প্রশ্ন শৈশব থেকেই ঘোরা-ফেরা করে। এগুলোর বাস্তব সম্মত কোন উত্তর না পেলে সে সন্তুষ্ট হতে পারে না। এই চিন্তাগুলোর উত্তরের উপরই নির্ভর করে প্রতিটি মানুষের জীবন পদ্ধতি (Life Style)। । যেমন; একজন নাস্তিকের জীবন পদ্ধতি এক রকম পক্ষান্তরে আস্তিকের জীবন পদ্ধতি আরেক রকমের। মতবাদের সঠিকতার আরেকটি নির্ণায়ক হলো এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির সাথে মানানসই কি-না।
এবার আমরা একটু উপরিউল্লিখিত নির্ণায়ক গুলোর আলোকে ও আমাদের সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের পক্ষে যে সকল যুক্তি বিদ্যমান সেগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি ও বাস্তবায়নের ফলাফলগুলো পর্যালোচনা করবো।
১। পশ্চিমের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা প্রায়ই বলে থাকে, “keep your religion to yourself, don’t bring it into politics” একই সুর ধরে আমাদের দেশের কেউ কেউ বলে, “ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার” কিন্তু এই ধারণাটা যৌক্তিক কিনা তা সমাজের সর্বোচ্চ সংগঠনটির(রাষ্ট্র) দিকে তাকালে দেখতে পাই। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত ধর্ম ও ধর্ম প্রচারক এসেছে সকলেই সমাজ সংস্কারের কাজ করেছেন। কিন্তু রাজনীতি ছাড়া সমাজের পরিবর্তন কখনো সম্ভব নয়। সকল ধর্ম প্রচারকরাই রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার নীতি গুলোকে পরিবর্তিত ও প্রভাবিত করেছিলেন এবং বিধিবিধান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই বলা যায় সমাজে মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াই এক ধরনের রাজনৈতিক প্রচেষ্টা। যে সমাজে ধর্ম বিদ্যমান সেখানে ধর্মের চিরায়ত প্রবনতা হলো সমাজ সংস্কার করা। অর্থাৎ ধর্মের প্রবনতা থেকেই ধর্ম ও রাজনীতির সুগভীর সম্পর্ক প্রতিয়মান। উদাহরন হিসেবে বলা যায় আরবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবার পর সেখানকার সমাজ ব্যাবস্থা ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তিত হয়ে যায়।
২। “কেউ যেন তার ধর্মীয় বিশ্বাস কে অন্যের উপর না চাপিয়ে দিতে পারে তাই ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখা উচিৎ।” এ যুক্তিটি ও একটি খোড়া যুক্তি কারন সমাজে বসোবাসকারী এক জনের চিন্তা দ্বারা সব সময়ই অন্যে প্রভাবিত হয়। চিন্তার চরিত্রটাই এমন যে তা পূর্ববর্তী কোনো চিন্তার ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে। এছাড়া সমাজ বা রাষ্ট্রে ধর্মের প্রভাব থাকবে না, এটাকেও আমরা একটা নতুন এক ধর্মীয় মতাদর্শ বলতে পারি। যে ধর্মের নাম ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ’। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ সৃষ্টিকর্তা ও ধর্ম সম্পর্কে নতুন চিন্তা সহকারে এক নতুন মতাদর্শ সমাজে নিয়ে এসেছে। যা অন্যান্য ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন কোন কর্তৃপক্ষ যদি বলে ‘এখানে কোন আইন থাকবে না’। এটাও একটা নতুন আইন সৃষ্টি করে। স্বরুপ ইসলাম রাষ্ট্রে সুদ ভিত্তিক অর্থনীতির অনুমোদন দেয় না। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ পুজিবাদী রাষ্ট্রে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া আইন মান্য করা বা ধর্ম পালন করা সম্ভব নয়। বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদই অন্য ধর্মের স্বাধীনতা দেয় না।
৩। কেউ কেউ বলে “ এই আধুনিক যুগে সৃষ্টিকর্তার আইন বা ধর্মীয় আইন অচল। ধর্মীয় আইন এখন সেকেলে”। কিন্তু বাস্তবতা হলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি(instinct) সব সময় স্থির ও অপরিবর্তনশীল। সব কালেই মানুষের শারীরিক ও মানসিক ক্ষুধা ছিল, আছে ও থাকবে। তাই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি অপরিবর্তনশীল হওয়ায় অতীতে যা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ও মনুষ্য সমাজের জন্য ক্ষতিকর ছিল ভবিষ্যতেও তা একই রকম থাকবে। অতীতেও নারী-পুরুষের মধ্যে জৈবিক ক্ষুধা, সন্তান উৎপাদন ও সম্পদের মালিকানার আকাঙ্ক্ষা, আধ্যাত্মিক ক্ষুধা(Spritual instict)/বড় শক্তির আনুগত্য করা/সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করার বিষয়গুলো বিদ্যমান ছিল, বর্তমানেও আছে ভবিষ্যতেও থাকবে। আর এ সকল চাহিদাগুলো সুষ্ঠুভাবে পূরণের মধ্যেই সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিদ্যমান। তাই এ চাহিদাগুলো পূরণের জন্য একটি সার্বজনীন সর্বযুগ উপযোগী নীতি ও আইন থাকাটাই ব্যাঞ্জনীয় ও যৌক্তিক। যেহেতু সৃষ্টিকর্তা মানুষের এসকল প্রবৃত্তির স্রষ্টা, তাই সব যুগের উপযোগী,সব জাতি, বর্ণের মানুষের সবচেয়ে সুন্দর ভাবে এগুলো পূরণ করার বিধান তিনিই(আল্লাহতায়ালা) শুধু ঠিক ভাবে দিতে সক্ষম। সুতরাং সৃষ্টিকর্তার আইনের ক্ষেত্রে একাল-সেকাল বা আধুনিক-অনাধুনিক বলা অযৌক্তিক। তাছাড়া আমাদের সুখ-দুঃখের অনুভুতি, হাসি-কান্না, ছোটদের স্নেহকরা, সত্যবাদীকে পছন্দ করার মত বিষয়গুলো তো সৃষ্টির শুরু থেকেই চলে আসছে। পুরাতন বলে কি এগুলো আমরা পরিহার করি? অথবা নতুন রোগ বলে কেউ কি এইডসকে স্বাগতম জানায়? তাই পুরাতন কোন কিছু বর্তমান যুগের জন্য ভাল নয় এবং নতুন বলে কোন কিছু ভালো হবে এরও কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই।
এবার আসা যাক আরো কিছু বাস্তবিক যুক্তির আলোচনায়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের উদ্ভব হয়েছিল চার্চের শোষণ নির্যাতনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার(Negative Reaction) ফল স্বরুপ। কিন্তু কোনো ঠিক বা শুদ্ধ মতবাদ কখনো পরিবেশের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া থেকে জন্ম নিতে পারে না। কারন ঐ পরিবেশ-পরিস্থিতি যদি সরিয়ে ফেলা হয় বা ভিন্ন রকম হয় তাহলে ঐ মতবাদের সমস্ত ধারনা(Concept) অগ্রহনযোগ্য বা বাতিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ ধরা যাক চার্চের শাসনে যদি ইউরোপে শান্তি বিরাজ করতো তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা সেখানকার মানুষের কাছে থাকত সম্পূর্ণ অগ্রহনযোগ্য। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ কোন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠেনি।
সর্বজন স্বীকৃত ও প্রমানিত ঈসা(আঃ) এর উর্ধ্ব আরোহণের পর ঈঞ্জিলের বার বার সংস্করণ করা হয়। ফলে এর মধ্যে খ্রিস্টান যাজকেরা তাদের মনগড়া মতবাদ, চিন্তা-ভাবনা ঢুকিয়ে এর মৌলিকত্ব নষ্ট করে ফেলে। ফলে এটি হয়ে ওঠে আরেকটি মানুষের তৈরি রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালনার দলিল। তাই ধর্মনিরপেক্ষবাদী বিপ্লবের পর আরেকটি মানুষের তৈরি ব্যাবস্থাই গ্রহন করা হয়। নতুন উৎসও সেই মানব সৃষ্ট মতবাদ। যার মধ্যে ভুল ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ইউরোপে মূলতঃ কোন পরিবর্তন আসেনি। কারণ একটি মানুষের তৈরি ব্যাবস্থা পরিবর্তিত হয়ে আর একটি মানুষের তৈরি ব্যাবস্থা এসেছে। এছাড়া খ্রিষ্টান ধর্মের অভিজ্ঞতা দিয়ে সব ধর্মকে বিচার করা যৌক্তিক নয়। এবং বাকি সব ধর্মে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বাণী বিকৃত হয়েছে এ ধারণাও ঠিক নয়। কারণ ইসলাম ধর্মের কুরআনই তার বাস্তব প্রমাণ। কুরআনের আদর্শ বাস্তবায়নের ফলে ইউরোপের মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন আরব ঐ সমকালীন সময়েই ১৪০০ বছরের এক স্বর্ণালী সভ্যতার নিদর্শন হয়ে আছে। খিলাফতের শাসনামলে এ রাষ্ট্র জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক উতকর্ষতার অনবদ্য এক উদাহরণ। কিন্তু আজকের মুসলিম বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায় কুরাআন-সুন্নাহর আদর্শ ভিত্তিক সেই রাষ্ট্র ব্যাবস্থার অনুপস্থিতিতে পর্যাপ্ত সম্পদ হাতে থাকা সত্ত্বেও মুসলিমরা আজ দরিদ্র পীড়িত, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-অর্থনীতির দিক থেকে পিছিয়ে পরা এক জাতি। তাই আবারো সারা বিশ্বের মুসলিমরা ইসলামী আদর্শিক রাষ্ট্র ব্যাবস্থা ফিরিয়ে আনতে সোচ্চার।
আমেরিকা বা ব্রিটেনে প্রথম সংবিধান প্রনয়ণ ও গ্রহণকালে সেখানকার সমাজে সমকামিতা প্রচন্ডভাবে ঘৃনা করা হতো, আর পর্ণগ্রাফির কথা তো কল্পনাই করা যেত না। কিন্তু সে সময়ের সংবিধান প্রনেতারা যদি আজকে দেখতেন, তাদের সংবিধান অনুসরণ করে সমকামীরাই আজ সহজে পার্লামেন্ট সদস্য হচ্ছে। পর্ণগ্রাফি বিস্তরভাবে ছড়ানো হচ্ছে সমাজে। এবং ব্রিটেনে দশ লক্ষেরও বেশি নাগরিক বিভিন্ন অপরাধে জেলের মধ্যে রয়েছে। এসব অনুধাবন করার ক্ষমতা তাদের থাকলে তারা এ সংবিধান ভিন্নভাবেই লিখতেন। অর্থাৎ এ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় মানুষের সীমিত জ্ঞানের পরিধি দিয়ে এবং ভবিষ্যৎ বাস্তবতা বিশদ ও ঠিক ভাবে বুঝতে পারার অক্ষমতার কারণে মানুষের তৈরী জীবন বিধান দিয়ে সমাজ কখনো সর্বযুগোপযোগী ব্যাবস্থা সহকারে শান্তিপূর্ণভাবে চলতে পারে না।
ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষের সহজাত প্রকৃতি বা স্বভাব বুঝতেও ব্যার্থ হয়েছে। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায় পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন মানুষ বড় কোন শক্তি বা তার চেয়ে চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে অধিকতর শ্রেষ্ঠ মনে করে তার আনুগত্য প্রকাশ করতে চায় যেমন- কেউ সূর্য, চন্দ্র, বৃহৎ গাছ, আগুন। আবার কেউ কেউ তার চেয়ে উন্নত কোন মানুষের চিন্তার পুজারী যেমন মার্কস ও লেলিনবাদীরা। কিন্তু সমস্যাটি ঘটে তখন, যখন বস্তু ও মহাজগতের প্রকৃত সৃষ্টিকর্তার উপাসনা না করে মানুষ কোন সৃষ্টি বস্তুর আনুগত্য করে। সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করার তার সহজাত প্রবৃত্তিকে ভুলভাবে নিবৃত করতে চায়। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মানুষের কাছে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও তার উপাসনা করা বা না-করার ব্যাপারে কোন ঠিক ও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। পশ্চিমের মানুষের আধ্যাত্মিক চিন্তার খোরাক যোগাতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ চুড়ান্তভাবে ব্যর্থ। তাই দেখা যায় অনেক অর্থ-বিত্তের মাঝেও বিষণ্নতা ও মানসিক রোগ পশ্চিমে মহামারি আকার ধারন করছে। সর্বোপরি সবচেয়ে বড় শক্তিধর সৃষ্টিকর্তার উপর মানুষের যে নির্ভরতা বা তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার মানুষের যে সহজাত আকাঙ্ক্ষা তা মূলতঃ সৃষ্টিকর্তার হুকুম বা সামগ্রীক জীবন বিধান মান্য করারই নির্ভরতা বা মনস্ত্বাত্ত্বিক ক্ষুধা। তাই মানুষ সহজাতভাবেই সৃষ্টিকর্তার জীবন ব্যাবস্থা ব্যাক্তিগত জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ও মানতে চায়। এবং তা মান্য করেই প্রশান্তি লাভ করতে পারে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মানুষের জীবনের এই সকল মৌলিক চাহিদার যোগান দিতে সম্পূর্ণরুপে ব্যার্থ হয়েছে।
ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বিপ্লবে সৃষ্টিকর্তার ধর্মকে অস্বীকারকারী গোষ্টির সঙ্গে ধর্মকে বা সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাসকারী চিন্তাবিদদের যে কম্প্রমাইজ বা আপোষ হয়েছিল সেটিও ছিল ভিত্তিহীন ও অযৌক্তি। কেননা দুটি সাংঘর্ষিক বা বিপরীতমূখী বিষয়ের মধ্যে কখনো আপোষ হওয়া অসম্ভব। উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেমন এক দল লোক বলল, ঢাকা নামে একটি শহর আছে। আরেক দল লোক বলল, ঢাকা নামে কোন শহর নাই। তখন তাদের মধ্যে কম্প্রমাইজ হয়ে এর মাঝামাঝি কোন মতে পৌছান হয়, তাহলে সে সমাধান হবে সত্য বিবর্জিত। তাই সৃষ্টিকর্তা আছে, না সৃষ্টিকর্তা নেই এ দুটির মাঝে কম্প্রমাইজও কোন ঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারে না। কারণ এ দুটোর যে কোন একটি বাস্তবতা সত্য ধারণ করে। তাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ মহাজগতের সাথে সম্পৃক্ত, মানুষ ও সমাজের সাথে সম্পৃক্ত এই সত্যকে বা এই বিষয়টিকে যখন মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও রাষ্ট্র থেকে আলাদা রাখতে চায় অযৌক্তিকভাবে। সৃষ্টিকর্তা কি শুধু মানুষের ব্যাক্তিগত জীবনের সমস্যা সমাধান দিতে পারেন, তিনি কি সমষ্টিগত জীবনের সমাধান দিতে পারেন না? প্রত্যেকটি মানুষকে সৃষ্টিকর্তার বিষয়ক এ মৌলিক প্রশ্নের ঠিক উত্তর না দিলে, তা মানুষের জীবনে ও সমাজে অসঙ্গতি, অসামঞ্জস্যতা, স্ব-বিরোধীতা ও অনিয়ম ছাড়া কিছুই দিতে পারেনা। কারণ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা মানুষ এবং সমাজের ব্যাপারে কোনটি ভালো কোনটি খারাপ চুড়ান্তভাবে বলতে পারেনা। সুখ, প্রশান্তি ও তৃপ্তির ধারণায় থাকেনা কোন ঐক্য। ফলে সৃষ্টি হয় দিধা-দ্বন্দ্ব(confusion) ও অসামঞ্জস্যতা (contradiction)। সত্য ও মিথ্যার কম্প্রমাইজ তাদের জীবনে নিয়ে আসে চুড়ান্ত বিভ্রান্তি। এর প্রতিফলন আমরা ধর্মনিরপেক্ষ জাতিগুলোর নীতি প্রণয়ন ও জীবন পদ্ধতি (life style) এর মধ্যেও স্পষ্ট দেখতে পাই। পাশাপাশি আমরা দেখতে পাই মানুষের স্বভাবের সঙ্গে মানানসই ব্যাক্তিগত জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সৃষ্টিকর্তার আদেশ নিষেধ মেনে জীবন যাপনের ব্যাবস্থা (System) শুধু ইসলামই দেয়। এখানে ভালো-মন্দ শরিয়া আইনের মাধ্যমে স্থায়ী ভাবে নির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট এবং যা বাস্তবায়ন যোগ্য। এর প্রমাণ হলো ইসলামী খিলাফতের ১৪০০ বছরের ইতিহাস।
রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করার পরই সেখানে বিপ্লব (Industrial Revolution) ঘটার পর অর্থনৈতিক ও টেকনোলজির উন্নয়ন ঘটেছে। এই উদাহরন পশ্চিমারা অনেক মুসলিমকে বোঝানোর চেষ্টা করছে এখনো। কেউ কেউ ভুল করে এ মতবাদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিন্তু আসল কথা হলো যে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার স্লোগান নিয়ে যে উন্নয়নের কথা তারা বলেছিল তার বাস্তবায়ন কি আজও ঘটেছে? যতটুকু ঘটেছে সে বস্তুবাদী উন্নয়ন তাদের আজ কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে? ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ধারণ করার পর যে পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী জীবন যাপনের দিকে তারা ধাবিত হয়েছে সে কারণে সারা বিশ্ব থেকে অন্যান্য জাতির সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়ার কৌশল তারা অবলম্বন করেছে। সৃষ্ট হয়েছে উপনিবেশবাদ, নব্য উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের। অন্যান্য জাতিগুলোকে অসাম্য ও পরাধীনতার মধ্যে ঠেলে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা কি নিজেদের সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে? পৃথিবীর অধিকাংশ পুঁজির মালিক এখন গুটি কয়েক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী। সম্পদশালী পুজীর মালিকরাই তাদের স্বার্থরক্ষাকারীদের তাদের শাসন ক্ষমতায় বসায়। চার্চের শাসনামলের মতো ইউরোপের মানুষ এখনো প্রচন্ড রক্ষণশীল। অভিজাত শ্রেণীর সামাজিক কাঠামোর (Aristocratic Social Class Structure) কারণে এখনো এ অভিজাত শ্রেণীর মানুষেরা জনগণের কোন ম্যানডেট ছাড়াই বৃটেনের লর্ডসভার সদস্য পদ লাভ করে। শ্রমিক শ্রেণীর মানুষেরা এখনো প্রচন্ড ভোগান্তি ও বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষবাদী এই বিপ্লব সংখ্যা গরিষ্ট মনুষের এই দুর্ভোগ কোন উল্লেখযোগ্য হারে কমাতে পারেনি। এখনো সংখ্যা গরিষ্ট মানুষ অর্থনৈতিক দাসত্বের মধ্যেই রয়েছে। এর উদাহরন হলো- ২০০৭ সালে ও আমেরিকাতে আড়াই(2.5) কোটি ভাসমান মানুষ বসবাস করে।
অপর পক্ষে পশ্চিমের মানুষের সামগ্রীক জীবনের চিন্তা চেতনা ও সংস্কৃতিক কাঠামো আজ সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে জর্জরিত। ধর্মনিরপেক্ষবাদ তাদের সমাজে সীমাহীন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। শুধু বস্তুর মাঝে সুখ তথা ভোগের মাঝে সুখ এই মিথ্যা ধারণা, হতাশা ও বিভ্রান্তি ছাড়া কিছু দেয়নি। তাই আমরা যখন দেখি পৃথিবির ৪% এর ও কম আমেরিকায় বাস করে কিন্তু তারা পৃথিবীর ৩৫% এর ও বেশী সম্পদ ভোগ কর। এমনকি আমেরিকার মধ্যেও সেখানকার ১০% মানুষ সে দেশের ৯০% এরও বেশি সম্পদের মালিক। এবং সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। আর সে দেশেরই পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠি শুধু সম্পদ লুটের নেশায় পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতামতের প্রতি বৃদ্ধা আঙ্গুলি উচিয়ে গুচ্ছ বোমার আঘাতে হত্যা করে আফগানিস্তান ও ইরাকের লক্ষ লক্ষ আবাল বৃদ্ধ-বনিতাকে। এ দৃশ্য দেখে সচেতন মানুষেরা সত্যিই বিষ্ময়াভিভূত হয় না। দুঃখ ও শোকে এ ভ্রান্ত চিন্তা বহনকারীদের নিবারণের জন্য ফেটে পড়ে রাজপথে। যখন দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে তরুণ রবার্ট হক্সিন্স বিখ্যাত হবার আশায় ৮ জনকে গুলি করে আত্ম-হত্যা করে, তখন সুস্পষ্ট জীবন ব্যাবস্থা পাওয়া জনগোষ্টি মোটেই অবাক হয়না। যখন দেখা যায় ব্যাক্তি স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলে তারা মুখে ফেনা তুলে ফেলে অথচ ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদের সুতিকাগার রাষ্ট্রে (ফ্রান্স) ‘হিজাব’ নিষিদ্ধ করা হয় আইন করে; তখনও মোটেও আশ্চার্যান্বিত হওয়ার কিছু থাকেনা। যখন দেখা যায় ইউরোপ আমেরিকার নারীরা নিজের বাচ্চা ও স্বামীর চেয়ে পোষা কুকুরের প্রতি যত্নশীল তখন হতবাক হবার কিছুই নেই। কারন বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ভিত্তিহীন ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী অযৌক্তিক চিন্তাই তাদের চিন্তা-ভাবনা ও জীবন পরিচালনার ভিত্তি। এই ভুল মতবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা চিন্তা, ধারণা ও জীবন দর্শনই আজ তাদের পতনের শেষ প্রান্তে নিয়ে এসেছে।